পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সাড়ে ৩৭ লাখ মামলার জটাজালে বিপর্যস্ত বিচারাঙ্গন। বিদ্যমান কোর্ট-কাচারিগুলোর ত্রাহি দশা। বিশৃঙ্খলা, দুর্ভোগ, অনিয়ম-দুর্নীতির ভিড়ে মামলার ফেরে পড়া বিচারপ্রার্থীর রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটি। রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার এ এক জটিল কঠিন সমীকরণ। এসবের ধার না ধেরে প্রতিষ্ঠিত সরল এক বিচারব্যবস্থার নামই হচ্ছে ‘গ্রাম আদালত’। যে আদালতে নেই কালো গাউন পরা উকিল-মোক্তার-পেশকার। তবে রয়েছে লাল সালু বেষ্টিত এজলাস, কাঠগড়া। তবে নেই ১৪ শিকের গারদ। ইউনিয়ন পরিষদে বসছে ‘আদালত’। ফরিয়াদী-প্রতিবাদী উভয়েই হাজির। মজলিসে উপস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বাদী-বিবাদী সপক্ষে প্রমাণ ও সাক্ষী-সাবুদ হাজির করেন। তারা উভয়ের কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শোনেন। অতঃপর হাজেরানে মজলিশের সামনে থমথমে ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঘোষিত হয় রায়। সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষিত এ রায় উভয়পক্ষ মেনে নিতে বাধ্য। কারণ এই ‘গ্রাম আদালত’-এর রয়েছে আইনগত শক্ত ভিত্তি। গ্রামে বসবাসকারী প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আইনগত প্রতিকার লাভের জায়গা হিসেবে ক্রমেই আস্থা লাভ করছে গ্রাম আদালত। নামমাত্র খরচে (বিচার্য বিষয় ভেদে ১০ থেকে ২০ টাকা) ছোটখাটো অপরাধের বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে এই আদালতে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা গ্রাম্য সালিসের সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয় ১৯৭৬ সালে অধ্যাদেশ করে। নাম করা হয় ‘গ্রাম আদালত’। ২০০৬ সালে ‘গ্রাম আদালত’ আইনগত ভিত্তি পায়। ২০১৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়। অধ্যাদেশ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান এবং বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয় পাঁচ সদস্যের ‘গ্রাম আদালত’। উভয়পক্ষের মনোনীত দু’জন বিচারকের মধ্যে একজনকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। যদি কোনো কারণে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে অপারগ হন অথবা তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তাহলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোনো সদস্যকে (যাকে কোনো পক্ষ মনোনীত করেনি) গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান মনোনীত করেন। যদি কোনো পক্ষ ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্যকে পক্ষপাতিত্বের কারণে মনোনীত করতে না পারলে চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে অন্য কোনো ব্যক্তিকে গ্রাম আদালতের সদস্য করা যাবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত সক্রিয়। সে হিসাবে দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি গ্রাম আদালতে বিচার কার্যক্রম চলছে।
গ্রাম আদালতের এখতিয়ার : দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় অপরাধের বিচার হয় গ্রাম আদালতে। দেওয়ানি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে চুরির টাকা আদায়ের মামলা, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, দখল হারানোর এক বছরের মধ্যে স্থাবর সম্পত্তি দখল উদ্ধার, ধ্বংসকৃত অস্থায়ী জিনিসপত্রের ক্ষতিপূরণ আদায় এবং গবাদি পশুর অনধিকার প্রবেশের জন্য খেসারতের মামলা। ফৌজদারি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে বেআইনিভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত ব্যক্তি বা জনতার সদস্যসংখ্যা ১০ বা তার কম হতে হবে (ধারা ১৪৩ ও ১৪৭ দ: বি:), সাধারণ আঘাত, অপরাধজনক অনধিকার প্রবেশ, ক্ষতিকারক কাজ, ক্ষতির পরিমাণ সবোর্চ্চ ৫,০০০ টাকা (ধারা ৩১২, ৪২৭ ও ৪৪৭ দ: বি:) হাতাহাতি, বেআইনি অবরোধ, অবৈধ শক্তি প্রয়োগ, অবৈধ ভয়ভীতি প্রদর্শন, মাদকাসক্তি, ইঙ্গিতের মাধ্যমে নারীর শ্লীলতাহানি ইত্যাদি (ধারা ১৬, ৩৩৪, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫৮, ৫০৪ (১ম ভাগ), ৫০৮, ৫০৯ ও ৫১০ দ: বি:), সব ধরনের চুরি (চুরিকৃত মূল্যের পরিমাণ ৫,০০০ টাকা বা তার কম হলে (ধারা ৪৭৯, ৩৮৫ ও ৩৮১ দ: বি:), অস্থাবর সম্পদ আত্মসাত, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা, দলিলাদির ধ্বংস সাধনের (ধারা ৪০৩, ৪০৬, ৪১৭ ও৪২০ দ: বি:) মামলা। সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড দিতে পারে। আদালতের আদেশ না মানলে কিংবা অবমাননা করলে সর্বোচ্চ ৫শ’ টাকা জরিমানা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নয়- এমন কোনো দলিল দাখিল করতে অস্বীকার করলে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা অর্থদন্ড করতে পারে। গ্রামের অধিবাসীরা যে কেউ আবেদনের সঙ্গে ২ থেকে ৪ টাকা কোর্ট ফি স্ট্যাম্প লাগিয়ে গ্রাম আদালতের কাছে বিচার চাইতে পারেন। তবে আনুষঙ্গিক খরচ ধরে হালে গ্রাম আদালতের সাকুল্য খরচ ৫০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
গ্রাম আদালতের সীমাবদ্ধতা : তবে গ্রাম আদালতের কিছু সীমারেখাও এঁকে দেয়া হয়েছে আইনে। যেমন- অভিযুক্ত ব্যক্তি আগে যদি কোনো উচ্চতর আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে থাকেন, যদি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির সম্পত্তি গ্রাসের বিষয় জড়িত থাকে, বিদ্যমান কলহের ব্যাপারে কোনো সালিসের ব্যবস্থা করা হলে, সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা কোনো সরকারি কর্মচারীর পক্ষ হয়ে থাকলে গ্রাম আদালত সেই বিচার আমলে নিতে পারবে না। গ্রাম আদালত কাউকে কারাদন্ড দিতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৫ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণ, খুন, এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, অপহরণ, ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধেরও বিচার করতে পারে না গ্রাম আদালত।
বাড়ছে সুফলভোগী : স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, ইউএনডিপি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশের ‘গ্রাম আদালত’ সক্রিয়করণ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প হাতে নেয়। চট্টগ্রামসহ দেশের ২৭টি জেলায় এ প্রকল্প চলে। তাতে দেখা যায় ২০১৮ সালে শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই ১ হাজার ২৫৬ বিচারপ্রার্থী গ্রাম আদালত থেকে প্রতীকার পেয়েছেন। গ্রাম আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার ৮৬ শতাংশ। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি, স›দ্বীপ এবং সীতাকুন্ড উপজেলার ৪৬টি ইউনিয়নে প্রকল্পটি চলছে। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত এসব এলাকার গ্রাম আদালতে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৬৩টি মামলা এসেছে হাইকোর্ট থেকে। এর মধ্যে সে বছর জুলাইয়ে ১২৯টি, আগস্টে ৯৩টি, সেপ্টেম্বরে ৭১টি, অক্টোবরে ১২৮টি, নভেম্বরে ১১২টি, ডিসেম্বরে ৯৬টি, জানুয়ারিতে ১০২টি, ফেব্রæয়ারিতে ১০৩টি, মার্চে ১১৮টি, এপ্রিলে ১৫১টি, মে মাসে ১১৪টি এবং জুনে ৮১টি মামলা দায়ের হয়। ইতঃপূর্বেকার ১৯০টিসহ মোট ১ হাজার ৪৮৮টি মামলা হয়। বিপরীতে এ সময় বাতিল ও নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ২৫৬টি মামলা। এর মধ্যে সে বছর জুলাইয়ে ১০৬টি, আগস্টে ১০৯টি, সেপ্টেম্বরে ৭৭টি, অক্টোবরে ৮৫টি, নভেম্বরে ৯২টি, ডিসেম্বরে ১০৭টি, জানুয়ারিতে ৮৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ১০৭টি, মার্চে ১৩৭টি, এপ্রিলে ১৭৭টি, মে’তে ১২৫টি এবং জুনে ৪৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। তবে চট্টগ্রামের বাইরে অন্য জেলাগুলোতেও গ্রাম আদালত থেকে সুফল পাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। তবে গ্রাম আদালতের কিছু বাস্তবতাও রয়েছে। কুমিল্লা জেলাধীন মেঘনা উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান দিলারা শিরিন বলেন, গ্রাম আদালতের তথ্যটি অনেকেই জানেন না। ব্যাপক প্রচারণা দরকার। যারা গ্রাম আদালত পরিচালনা করেন এ বিষয়ে তাদেরও সম্যক ধারণা নেই। দলীয় এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ বিবেচনায় বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই গ্রাম আদালতের বিচারক হিসেবে ‘নিরপেক্ষ’ নন। বিচারের ক্ষুদ্র এ পরিসরেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার বলেন, গ্রাম আদালত থেকে সুফলভোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ছোটখাটো অনেক বিবাদের মীমাংসা এখন গ্রাম আদালতের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। এসব আদালত বিচার বিভাগের ওপর চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব (আইন ও বিচার) মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গ্রহণযোগ্য বিচারব্যবস্থা হচ্ছে ‘গ্রাম আদালত’। বিচারিক আদালত এবং উচ্চ আদালতের মামলা জট হ্রাসে সরকার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহিত করছে। গ্রাম আদালতও মামলার চাপ হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।