Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে নৈরাজ্য চলছেই!

৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের ভুলে : ইলিয়াস কাঞ্চন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

৮ বছর বয়সী সাগর, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। গতকাল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সিংহেরচালা গ্রামের সাগর সিংহেরচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরবে। মা লাভলি ছেলের জন্য স্কুলের অনতিদূরে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ দুটি সিএনজি’র পাল্লাপাল্লি দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে সাগরকে চাপা দেয়। মারা যায় সাগর। দু’দিন আগে মুন্সিগঞ্জে বরযাত্রীর মাইক্রোয় যাত্রীবাহী বাস ধাক্কা দিলে একই পরিবারের ৭ জনসহ ১০ জন প্রাণ হারায়। প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু সড়কে নৈরাজ্য চলছেই। নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করতে গিয়ে নানামুখি বাধার মুখে পড়ছে সরকার। জানতে চাইলে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নতুন আইন কার্যকর হলে সড়কে দুর্ঘটনা কমে যাবে। কারণ সড়কে শতকরা ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে চাকলদের কারণেই।

গতকালও বাংলাদেশে সড়কপথে নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা বন্ধের জন্য সরকারের গঠিত কমিটির ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে চারটি কমিটি গঠন করেছে টাস্কফোর্স কমিটি। সচিবালয়ে শাজাহান খানের নেতৃত্বে কমিটির ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রথম সভা শেষে কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ১১১ দফা বাস্তবায়নে টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে। সেই ফোর্সের কাজ ছিল পরিবহন সেক্টরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বাস্তবমুখী পরিকল্পনা করা। সভায় ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়ন ও পরিকল্পনার জন্য চার সচিবের নেতৃত্বে চারটি সাব কমিটি করেছি। তারা নির্ধারণ করবে, কোথায় কী কাজ করতে হবে। তিনি জানান, যোগাগাযোগ সচিব, জননিরাপত্তা সচিব, তথ্য সচিব ও স্থানীয় সরকারের মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে এই চারটি কমিটি গঠন করা হয়। দুই মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ ও পরিকল্পনা তারা দেবেন। আবার টাস্কফোর্সের বৈঠক হবে। তাদের সুপারিশের সঙ্গে অ্যাকশন প্ল্যান দেবেন।

সড়ক-মহাসড়কে যেন শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছেই না। পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও কিছু শ্রমিক সংগঠনের হাতে গোটা সেক্টর জিম্মি হয়ে গেছে। সরকারের নতুন আইন বাস্তবায়নে তারা নীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
২০১৮ সালে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের মুখে সরকার ওই বছর জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস করে। এক বছর সময় দেয়ার পর সরকার পহেলা নভেম্বর আইনটি কার্যকর করে। কিন্তু পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগত পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর দুই দফায় ১৫ দিন সময় দিয়ে ১৫ নভেম্বর আইন কার্যকর করতে মাঠে নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা কৌশলে পরিবহন ধর্মঘট করেন। এতে জিম্মি দশায় পড়ে যান সাধারণ মানুষ। সরকার বাধ্য হয়েই পরিবহন সেক্টরের রথি-মহারথিদের সঙ্গে সমঝোতামূলক বৈঠক করতে বাধ্য হন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক; সড়কে নতুন আইন বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি নতুন আইন বাস্তবায়নে পুলিশ যাতে কাউকে হয়রানী না করেন সে নির্দেশনাও দেন। মন্ত্রীর এই ঘোষণায় সাধারণ মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেন। কিন্তু পরিবহন সেক্টরের মাফিয়াদের কারণে নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দেশের সড়ক পরিবহন খাত। তারা প্রশাসন এমনকি কোনো নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করছেন না তারা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানোর ভূমিকায় কাজ করায় তাদের হুমকি ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর বান্দরবন যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। ওই সময় তিনি ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন। ইলিয়াস কাঞ্চনের শ্লোগান ‘আমার মতো যাতে আর কারো স্বজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত না হয়’। সেই ইলিয়াস কাঞ্চনকে পরিবহন সেক্টরের মাফিয়ারা টার্গেটে পরিণত করায় সর্বত্রই প্রতিবাদ হচ্ছে। শিল্পী সমাজ ইলিয়াস কাঞ্চনকে অপমানের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

সূত্র জানায়, হাতে গোনা কয়েকজন পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রেখেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান। তিনি সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্য। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা হচ্ছেনÑ সারাদেশের বাস-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তিনি আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত। শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস হচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদক। শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-(বাসদ) কেন্দ্রীয় নেতা। বর্তমানে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের নামে এই পাঁচ নেতার হাতে পরিবহন খাত জিম্মি। তাদের সহযোগী হিসেবে সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা সড়ক অকার্যকরে ভূমিকা রাখছেন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই নেতাদের আঙ্গুলের নির্দেশে এখন পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

অন্যান্য সেক্টরে মালিক আর শ্রমিকের মধ্যে বিরোধ দেখা গেলেও পরিবহন সেক্টরে মালিক শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ মূলত চাঁদাবাজি কারণে। যাত্রীদের জিম্মি করে সড়ক পরিবহন খাতে তৎপর মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মূলত চাঁদাবাজি করে সংগঠিতভাবে। যানবাহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় ছাড়া মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের আর কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা চোখে পড়ে না। এ অবৈধ চাঁদার স্বার্থের সংঘাতে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যে কিংবা ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধ, পরিবহন ধর্মঘট, রুট দখল-পাল্টা দখলের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সড়ক, মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে চাঁদাবাজিতে একাট্ট।

নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামে। প্রথমে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। পরে রাজধানী ঢাকায় পরিবহন ধর্মঘট করা হয়। তাদের ইঙ্গিতে ট্র্যাক লরি শ্রমিকরা মালামাল আনা নেয়া বন্ধ করতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সঙ্কট সমাধানে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রিরা দফায় দফায় পরিবহন সেক্টরের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করছেন। কিন্তু সড়কে দুর্ঘটনা এবং চাঁদাবাজি বন্ধ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ