Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

মহাবিপদে হাতি!

বিচরণ ক্ষেত্র খাদ্য সঙ্কটে লোকালয়ে, ঘটছে প্রাণহানি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে পদপিষ্টে ৩ জন নিহত

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

নির্বিচারে পাহাড়-বন উজাড়, দখল আর অপরিকল্পিত উন্নয়নে হারিয়ে যাচ্ছে বিচরণ ক্ষেত্র। দেখা দিয়েছে খাদ্য সঙ্কট। আর এই কারণে লোকালয়ে চলে আসছে হাতির পাল। বিশালকায় অথচ শান্ত এই পশুর আক্রমণে ঘটছে প্রাণহানি। গেল নয় বছরে হাতির পায়ে পিষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৪৮ জন। চরম খাদ্যাভাব, দুর্ঘটনা আর মানুষের হামলায় মারা যাচ্ছে হাতি।

১৮ বছরে মারা গেছে ৮৮টি হাতি। খোদ সরকারের বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে মহাবিপদে আছে হাতি। বিচরণ ক্ষেত্রসহ নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার নিশ্চিত করা না গেলে বিপন্ন হতে পারে বন, বন্যপ্রাণি ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু ঐরাবত।

বনবিভাগের হিসাবে দেশে হাতির সংখ্যা ২৭০ থেকে ২৮০টি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটির আংশিক এলাকায় এসব হাতির বসবাস ও বিচরণ। শেরপুরেও হাতির বিচরণ ক্ষেত্র রয়েছে। তবে সেখানে বিচরণ করতে আসা হাতির পালের মূল আবাস ভারতে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতি চলাচলের ১২টি করিডোর রয়েছে। তবে নির্বিচারে বন উজাড় ও দখল করে বসতি স্থাপনের ফলে হাতির নিরাপদ বিরচণ ক্ষেত্র আগের মতো নেই।
বিশেষ করে উখিয়া টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরের জন্য পাহাড় আর বন-জঙ্গল কেটে ফেলায় হাতির চলাচলের স্থান সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণসহ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পও হচ্ছে হাতির চলাচলের পথ রুদ্ধ করে। আবার গভীর অরণ্যের আয়তন ও গাছপালা কমে আসায় একদিকে হাতির স্বাভাবিক চলাচল ব্যহত হচ্ছে অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কটও প্রকট হচ্ছে। এর ফলে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে লোকালয়ে হাতির পাল নেমে আসছে। চট্টগ্রামের আনোয়রা, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়াতে হাতির পাল নেমে বাড়িঘরের ক্ষতি করছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন বলেন, হাতির পাল দিনে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ হাঁটে। তবে এখন হাঁটার মতো জায়গা কমে আসছে। একটি হাতি দিনে দেড়শ থেকে দুইশ কেজি খাবার খায়। বাঁশ, কলাগাছ, এলিপ্যান্ট গ্রাস (ফুলের ঝাড়–র কাশ) আর লতা জাতীয় খাবার তাদের পছন্দ। তবে বন উজাড় হওয়ায় এসব গাছপালার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।
আবার সরকারিভাবে ভিনদেশি জাতের যেসব গাছ লাগানো হচ্ছে তাও হাতির খাবার আর বিচরণে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। বন সৃজন, বণ্যপ্রাণির সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হাতির অবদান অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রাণিকে বিপন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষায় এখনি কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, হাতির বিচরণক্ষেত্রে লোকজন চাষবাস করছে, ঘরবাড়ি তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। হাতির পাল তখন সে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দেয়। লোকালয়ে কোথাও কোন হাতি বা হাতির বাচ্চা আটকা পড়লে তারা ইকো সিস্টেমের মাধ্যমে হাতির পালের কাছে সে বার্তা পৌঁছে দেয়। ওই হাতিকে উদ্ধারে হাতির পাল তখন লোকালয়ে চলে আসে। বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, খাদ্য সঙ্কট আর নিরাপদ চলাচলের পথ না থাকায় হাতি কঠিন সঙ্কটে রয়েছে। এ অবস্থাকে আমরা হাতির জন্য ‘মহাবিপদ’ মনে করছি। সাধারণ মানুষ ভয় আতঙ্কে হাতির দলকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এজন্য তিনি জনসচেতনার অভাব আছে জানিয়ে বলেন, কোথাও হাতির পাল আসলে তাদের বনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বনবিভাগের প্রশিক্ষিত লোকজন রয়েছে।
তবে হাতির পাল লোকালয়ে আসার পর মানুষের ভিড় আর জটলার কারণে বনবিভাগের লোকজন তাদের কাজ করতে পারে না। হাতির পাল কারো ফসল কিংবা বাড়ি ঘর বিনষ্ট করলে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও আছে। তাই কোন জনপদে হাতির পাল আসলে তাদের পিছু না নিয়ে বনবিভাগের সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, নয় বছরে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবার ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮৮টি হাতি মারা গেছে। এদের বেশিরভাগ বয়সের কারণে মারা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষের হামলায় হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা কম। আবার পাহাড় থেকে পড়েও হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

তিনজনকে মেরে ফিরে গেল হাতির পাল
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় লোকালয়ে নেমে আসা হাতির পাল ২৪ ঘণ্টা পর ফিরে গেছে। তবে যাওয়ার আগে তিনজনকে পদপিষ্ট করে হত্যা করেছে। গতকাল সকালে উপজেলার কধুরখীল, চরণদ্বীপ ও শ্রীপুর-হরণদ্বীপ ইউনিয়নে হাতির পালের এই হামলা হয়। নিহতরা হলেন- চরণদ্বীপ ইউনিয়নের চাঁদেরহাট পূর্ব সৈয়দ নগর এলাকার জাকের হোসেন (৬৫), কধুরখীল ইউনিয়নের মধ্যম কধুরখীল শরীফ পাড়ার আবু তাহের মিস্ত্রী (৬৫) ও শ্রীপুর-হরণদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকার আব্দুল মাবুদ (৬০)। শনিবার ভোর থেকে নয়টি হাতি পূর্ব কধুরখীল ইউনিয়নে অবস্থান নেয়। হাতি আসার খবরে হাতির পালকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। দিনভর স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন হাতিগুলোকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

মানুষের ভিড়ের কারণে হাতিগুলো বায়তুল ফালাহ মসজিদ সংলগ্ন একটি সুপাড়ি বাগানে আশ্রয় নেয়। রাতে লোকজন সরে গেলে হাতির পাল পাহাড়ে ফিরে যেতে থাকে। বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা জানায়, হাতিরা ফিরে যাওয়ার সময় ঘন কুয়াশা ছিল। লোকজন বুঝতে না পেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে হাতির সামনে পড়ে যায়। হাতির পদপিষ্ট হয়ে ওই তিনজন মারা যায়। নিহত তিনজনের পরিবারকে বনবিভাগের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বোয়ালখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আছিয়া খাতুন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ