পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে রথীন্দ্রনাথ রায়ের ‘আমার এ দেশ ...সব মানুষের/ চাষাদের, মুটেদের, মজুরের/ গরিবের নিঃস্বের ফকিরের’ এই গান মুক্তিপাগল মানুষের প্রেরণা জুগিয়েছে। এ দেশ সৌহাদ্য ও সম্পৃতির। দলমত নির্বিশেষে সব ধর্ম, মত-পথ-চেতনার মানুষের বসবাস। এ জন্যই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত। দেশের লাখ লাখ মসজিদে মুসল্লিরা শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়েন, অলি আউলিয়া পীরের উরশে লাখো মানুষের পদভারে হয় মুখরিত; আবার মেলা, পার্বণে হোটেল-বারে তিল ধরণের ঠাঁই থাকে না। ইসলামী জলসা ও মাহফিলে যেমন হাজার হাজার তৌহিদী জনতা হাজির হন; তেমনি সার্কাস, পালাগান-যাত্রাগানের অনুষ্ঠানেও ভিড় করে হাজারো মানুষ। এটাই হলো- বাংলাদেশের চিত্র। সার্বভৌম এই দেশকে কোনো ব্যাক্তি, গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের ‘একার’ করে তোলা কাম্য নয়।
মহানবী (সা.) জন্মভূমি আরব দেশে। মক্কা-মদিনাসহ মুসলমানদের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। কিন্তু নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং গোত্রগত বিভেদ-বিশৃঙ্খলার কারণে এক আরব জাতি ১৯টি রাষ্ট্র বানিয়েছে। ভারতকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। ৩৬ জাতি এবং বহু ভাষাভাষির সে ভারত ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে’ পরিচিতি পাচ্ছে। বিজেপির শুধু হিন্দুদের জন্য ‘রাম রাজত্ব’ কায়েমের কবলে পড়ে ভারতের ৫০ কোটি (মুসলিম-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ) নাগরিকের বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশ এখন উন্নয়নশীল। আন্তর্জাতিক পরিসরে নিম্নবৃত্ত থেকে মধ্যবৃত্ত দেশে উন্নীত হতে চলেছি। শুধু উন্নয়নের চিন্তা মাথায় রেখে মুসলিম দেশ মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যেমন সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য; সে কারণে বাংলাদেশও হতে পারে আকর্ষণীয়। পর্যটকদের জন্য কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সুন্দরবন, সিলেটের পাহাড়, হাওর-বিল বিদেশীদের ভ্রমণেই খুলে দিতে পারে অর্থনীতির দুয়ার। সে কারণেই চলতি বছরে জাতীয় সংসদের বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থানীয় কমিটি পর্যটন শিল্পকে আকর্ষণীয় করতে বিদেশের দামের সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের বারগুলোতে মদের মূল্য নির্ধারণ করার সুপারিশ করে।
কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের অফিস থেকে ‘চার বোতল মদ’ উদ্ধার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে। আসিফের বিরুদ্ধে মামলা চলছে আদালতে। ২০১৮ সালের ৫ জুন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় আফিসকে গ্রেফতার হয়। তার কার্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয় ৪ বোতল মদ। লাইসেন্স ছাড়া বিদেশি মদ রাখায় আসিফের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৩ জুলাই তেজগাঁও থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় গত ১৩ নভেম্বর আসিফের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। আসিফ ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন। মদ রাখার ব্যাখ্যা দিয়ে মদ পানের অনুমতির লাইসেন্স আদালতে দাখিল করে আসিফ বিচারককে বলেন, ‘আমার নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ গ্রহণ করার অনুমোদন আছে। আমার ঘাড়ের পেছনের দিকে পেইন হয়, সে কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে মাঝে মধ্যে গ্রহণ করতে হয়। এই বিষয়ে আমি লাইসেন্স নিয়েছি। প্রতি বছর আমি সরকারকে ট্যাক্স দিই’। এ নিয়ে ফেসবুক-ব্লগ-টুইটারে বিস্তর বিতর্ক হচ্ছে।
‘মামলা আদালতে বিচারাধিন’ খাতায় আসিফের বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে উদাহরণ হিসেবে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হলো। প্রায় দেখা যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার করলেই তার বাসায় ‘মদ উদ্ধার’ করার খবর দেয়। এ যেন ক্রসফায়ারের পর প্রচারিত গল্পের মতোই। যার কারণে মানুষ সেসব বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা অপরিহার্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় সারাদেশে মদের বার রয়েছে ১১৮টি। এর মধ্যে ক্লাব-বার ২৮। এসব ক্লাব-বারের বেশিরভাগ ঢাকায়। রাজধানীতে ক্লাব বারের সংখ্যা ১৭। এ ছাড়াও হাজার হাজার মানুষ মদ পান করে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় অবৈধভাবে মদ বিক্রি হচ্ছে। ইসলাম ধর্মে মদ নিষিদ্ধ। মুসলিম দেশ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অ্যালকোহল জাতীয় মাদকদ্রব্য কোথায় বেচাকেনা, মদ্যপায়ীরা কোথায় বসে মদ পান করবেন তা নির্ধারিত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে মদ বিক্রয়ের ছাড়পত্র সংগ্রহ করা আবশ্যক। মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দিলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-আঞ্চলিক-মেট্রোপলিটন-বিভাগীয় কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ লাইসেন্সের আবেদন করতে হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, মুসলিম প্রহিবিশন রুল ১৯৫০ ও এক্সাইজ ম্যানুয়ালে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাহী আদেশে মদ্যপান ও কেনাবেচার বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়। মুসলিম নাগরিকদের জন্য মদ অবৈধ থাকলেও তারা চিকিৎসার প্রয়োজনে মদ পান করতে পারেন। ২১ বছরের নিচে ব্যক্তির কাছে মদ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মুচি, মেথর, ডোম, ঝাড়ুদার ও চা বাগানের শ্রমিক ‘পারমিট’ নিয়ে দেশি মদ কিনতে পারেন। দুই থেকে পাঁচ তারকাযুক্ত হোটেল, পর্যটন বা কূটনৈতিক এলাকা, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব ও ডিউটি ফ্রি শপে মদ বিক্রি অনুমদিত। বারের লাইসেন্স নিয়ে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার, ক্লাব বার রাখা যায়। এই নিয়ম মেনে মদ পান করা এবং মাদক জাতীয় দ্রব্য ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন সংগ্রহ-বিক্রি-সেবনের মতো অপরাধকান্ড এক নয়।
নাগরিক অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনগণের শারীরিক ও মানসিক সততা, জীবন ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; জাতি, লিঙ্গ, জাতীয় মূল, রঙ, বয়স, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, জাতিভুক্তি, ধর্ম, বা অক্ষমতার মতো ভিত্তিতে বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, একক অধিকার যেমন- গোপনীয়তা, চিন্তার স্বাধীনতা, বাকশক্তি, ধর্ম, প্রেস, সমাবেশ এবং আন্দোলনের স্বাধীনতা থেকে সুরক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু যেটা আইন অনুযায়ী নাগরিক অধিকার তা খর্ব করা এবং অপরাধের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।
মাদকে ছেয়ে গেছে দেশ। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে মাদকের বেচাকেনা হচ্ছে। এসব মাদক উঠতি বসয়ী তরুণ এবং বেকার যুবকদের জীবন ধ্বংস করছে। মাদক তথা ইয়াবার যারা গডফাদার তারা নির্বিঘেœ চলাফেরা করছেন। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন এমপির ‘ইয়াবার কান্ডারী’ চিহ্নিত হওয়ায় গ্রেফতার অতঃপর মুক্তি পেয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে লোকলজ্জায় তাকে বাদ দিয়ে তার স্ত্রীকে নমিনেশন দিয়ে এমপি করে আনা হয়। দেশকে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন জাতীয় মাদক মুক্ত করা আবশ্যক। কিন্তু অমুকের বাসায় দ্ইু বোতল মদ উদ্ধার, তমুকের অফিস থেকে ৩ বোতল মদ উদ্ধার এগুলো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে দেশে আইন অনুযায়ী লাইন্সেস করে মদ বিক্রি-পান করা যায় সে দেশে কেউ বাসায় মদ রাখলে কী বড় দোষের? তিনি মদ পান করে পথেপ্রান্তরে পাবলিক লুইসেন্সি করলে তা অপরাধ। শুদ্ধি অভিযানে মহামেডানের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁয়াকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তার বাসা থেকে মদের বোতল উদ্ধার হয়। কিন্তু তার স্ত্রী জানান, অসুস্থতার কারণে লোকমান মদ দূরের কথা বিড়ি-সিগারেট পর্যন্ত পান করেন না। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, ‘আমি যে লোকমানকে চিনি সে কখনোই মদ গাজা দূরের কথা সে বিড়ি-সিগারেট পর্যন্ত পান ছোঁন না’।
প্রাসঙ্গিকভাবে ‘সিসা’ বিষয়টি এসে যায়। শত শত বছর আগে আরবের শাসক ও দিল্লির মুঘল শাসকদের ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল সিসা। আরবের মরু প্রান্তরে এবং বাদশাহের দরবারে সাফারি নাইটে আরবি নৃত্যের তালে তালে নৈশভোজে মাংস-রুটি পর্বে সিসা সেবন করতেন। সমাজের ধনী পরিবারগুলোর আভিজাত্য ছিল ‘সিসা’। আভিজাত্যের সেই সিসা বিবর্তণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণির ছেলেমেয়ে বউঝিদের মধ্যে ব্যবহার বাড়ছে। সেই ‘সিসা’কে মাদকের তালিকায় ফেলা হচ্ছে। ‘সিসা’ মাদকের পর্যায়ভুক্ত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম’ বা বিজেপির ‘রাজ রাজত্ব’ কায়েমের অপচেষ্টা চলছে। যার কারণে সে দেশে কোটি কোটি সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে তো একক ধর্মের বা একক গোষ্ঠির রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িত সৌহাদ্য ও সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে সব ধরণের মানুষের বসবাস। চলমান উন্নয়ন এবং জাতি হিসেবে উন্নতির শিখরে উঠতেও এটা অপরিহার্য। কাজেই সব রুচির মানুষ নিজেদের মতো করে চলতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ অপরাধ করলে বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার চোখে অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কারো আলমিরা থেকে মদ উদ্ধার এবং ‘সিসা’ গ্রহণ এই ঠুনকো বিষয়কে বেশি প্রাধান্য দিলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ আমরা ‘মদ’ ঘৃর্ণা করলেও বিদেশির সাধারণ পানির মতোই মদ পান করেন। আবার দেশের কিছু মানুষ নিয়ম মেনেই সেগুলো পান করেন। একটি দেশে আলেমদের যেমন বসবাসের অধিকার রয়েছে; তেমনি যে উপর তলায় বিদেশি সমাজ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত তারও বসবাসের অধিকার রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতকে ডুবিয়েছে আরএসএস ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ করতে গিয়ে। বাংলাদেশ সৌহাদ্য ও সম্পৃতির দেশ। এ দেশ সব মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকুক; ভারতের মতো নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।