Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বছরে আয় ৫০০ কোটি টাকা

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁকড়ার চাহিদা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে দেশের কৃষকদের মধ্যে কাঁকড়া চাষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। খোলসের কাঁকড়ার উন্নত চাষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে উপক‚লীয় অঞ্চলে লাখ লাখ চাষি চিংড়ি চাষের পাশাপাশি কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। চার প্রজাতির শিলা কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে এর মধ্যে সাইক্লা সের্রাটা, সাইক্লা, ট্রানকোবারিকা, সাইক্লা পরমামোসেইন এবং আইএসসিএল্পোলিভিসিয়া কাঁকড়া দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকায় এসব চাষ হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে যাচ্ছে গড়ে আয় করছে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। সাড়ে তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। পাঁচ উপক‚লীয় এলাকায় শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ। তবে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৮৫৪ হেক্টর উপকূলীয় এলাকায় ১১ লাখ ৭৮৭ মে.টন উৎপাদন হয়েছে।

জানতে চাইলে শালী কাঁকড়া হ্যাচারির পরিচালক মাসুমা খানম বলেন, উপক‚লীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকের মুখে ফিরেছে হাসি। শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের কাঁকড়া-চাষি স্বপন কুমার মালো জানান, সাতক্ষীরার উপক‚লীয় এলাকায় প্রতি বছরই বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে কাঁকড়া চাষ। চিংড়ি চাষে লাভ না হওয়ায় কাঁকড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা। এ অঞ্চলেই প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে ওঠায় ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন তারা। সেখানে হ্যাচারি স্থাপিত হলে কাঁকড়া চাষ আরো বিস্তার লাভ করবে বলছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। চিংড়ির বদলে দেশের পাঁচ উপক‚লীয় জেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাঁকড়ার। এটি চাষে চিংড়ির মতো বেশি দামে পোনা কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই সাগরের লোনাপানিতে জন্মায় কাঁকড়া। জোয়ারে নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই লাখ লাখ পোনা আপনাআপনিই উঠে আসে। যেসব গ্রামের শতভাগ মানুষেরই জীবিকা ছিল সুন্দরবন-কেন্দ্রিক। তা গত কয়েক বছরের ব্যবধানে কাঁকড়া চাষে সেই সব গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে। এখন আর তাদের সংসারে কোনো অভাব নেই। আনুনিক পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করে এ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছে। তিন-চার বছর আগে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা আর কক্সবাজারের অনেক চিংড়ি-চাষি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দরপতনের কারণে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকিতে পড়েছিল। কিন্তু এখন আর সে দরপতন নেই। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর ১ লাখ ৭৮৭ মে.টন উৎপাদন হয়েছে; যার সব কাঁকড়া রপ্তানি করছে, যা দেশের অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে।

সরকারি একটি গবেষণায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঁকড়ার বাজার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সাল বিএনপি সরকারের আমলে সনাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পুকুরে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে হংকংয়ে কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানির মাধ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা। বর্তমানে শুধু মালয়েশিয়ায়ই প্রতি বছর ১০০ থেকে এক হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ মোট ১৮টি দেশের বাজারে বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। কাঁকড়া উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। এজন্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করা জরুরি। দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সমস্যার সমাধান। কারণ কাঁকড়ার চাষ লাভজনক দেখে অনেক বেকার যুবক এ চাষে উৎসাহী হওয়া সত্তে¡ও অর্থনৈতিক সঙ্কট ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ছিটকে পড়ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উপক‚লীয় অঞ্চলের বেকার যুবকদের কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছে কাঁকড়া-চাষিরা।

ড. ডুরিন আখতার জাহান ইনকিলাবকে বলেন, উপক‚লীয় দরিদ্র জেলে আর কৃষকরা প্রাকৃতিক উৎস থেকেই কাঁকড়া আহরণ করেন। এরপর স্থানীয় আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে তারা কেজিপ্রতি আড়াই শ’ টাকার বেশি পান না। অথচ ঢাকার মিরপুরে বিভিন্ন পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি কাঁকড়ার দাম এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। কাঁকড়া খুবই সুস্বাদু। একটি পরিপূর্ণ সামুদ্রিক মাছের সমপরিমাণ ভিটামিন ও প্রোটিন অনেক পাওয়া যায়।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, কাঁকড়ার বেশ কিছু প্রজাতি আইইউসিএন প্রণীত রেডলিস্ট (বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকা) অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে কাঁকড়ার চাষ সম্পর্কে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে সচেতনতার মাত্রা আরো বাড়াতে হবে।
সুন্দরবন এলাকায় সহস্রাধিক প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ সীমানায় ১২ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। এসব কাঁকড়ার মধ্যে মাইলা, শাইলা, সিরোটা ও শীলা প্রজাতি। মাইলা ও শীলা জাতের কাঁকড়া সবচেয়ে উন্নতমানের, তাই বিদেশে এগুলোর চাহিদা বেশি। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কাঁকড়ার মৌসুম। বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু সরকারিভাবে এটি এখনও রপ্তানি পণ্য হিসেবে গণ্য হয়নি। কাঁকড়া আহরণ পরিবেশের ক্ষতি করে এ যুক্তিতে সরকার ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাঁকড়ার বাজার দখল করে নেয় ভারত, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন পরে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সরকার রপ্তানির অনুমতি দিলেও আহরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। ২০বছর ধরে রপ্তানি হতো মূলত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কাঁকড়া। চাষিরা নদী, সাগর, ডোবা, জলাশয় থেকে কাঁকড়া আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সেগুলো রাজধানীতে পাঠাতেন। রপ্তানিকারকরা সেগুলো নিজেদের মতো করে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলো শুধু চাষ করা কাঁকড়াও রপ্তানি হচ্ছে।
শালী কাঁকড়া হ্যাচারির পরিচালক মাসুমা খানম বলেন, উপক‚লীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সারা জাগিয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকের মুখে ফিরেছে হাসি। কাঁকড়া চাষে জায়গা কম লাগে, খরচও অল্প। বালাইয়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে।

উপযোগী পরিবেশ, ভাইরাসমুক্ত ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় দিন দিন কাঁকড়ার চাষ ও খামার বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলগুলোতে। বিশেষ করে চিংড়িতে ভাইরাস, রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষীরা ঝুঁকছেন কাঁকড়া চাষে। সাতক্ষীরা জেলাতে চলতি বছর ৩০৮ হেক্টর জমিতে ২৮ লাখ খাঁচায় কাঁকড়া চাষ হয়েছে। সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ধরে খাঁচায় ছাড়া হয়। দশ-বারো দিনে খোলস পাল্টায় কাঁকড়া। চিংড়ি চাষের চেয়ে কাঁকড়া চাষে জনবল বেশি লাগায় দিন দিন এ জেলাতে কমছে বেকারত্ব।

খাঁচা পদ্ধতিতে কাকড়া চাষ লাভজনক। চাষিরা বলছেন, প্লাস্টিকের খাঁচায় একটি কাঁকড়া দুই-তিন সপ্তাহ পরিচর্যার পর তার খোলস পরিবর্তন করা হয়। এতে কাঁকড়ার ৮০ ভাগ ওজন বৃদ্ধি পায়। প্রকার ভেদে প্রতি কেজি কাঁকড়া ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে সাতক্ষীরায় চাষ হওয়া এসব কাঁকড়া ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উপক‚লীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। গেল অর্থবছরে সাতক্ষীরায় ২৫০ হেক্টর জমিতে কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ২০০ টন। চলতি অর্থবছর ৩০৮ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে বেশি হওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ