Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফের দখল সাতরাস্তা

ট্রাক উচ্ছেদে মরহুম মেয়র আনিসুল হকের মহুতি উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

রাজধানীর সাতরাস্তা মোড় থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়ক থেকে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড বারবার উচ্ছেদের পর আবারও ট্রাকের দখলে চলে গেছে। এই সড়কজুড়ে আবারও লাইন দিয়ে রাখা হচ্ছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের তিন সংগঠনের তালিকাভুক্ত প্রায় ১০ হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান এখানেই রাখা হয়। এছাড়াও প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে কাঁচামাল নিয়ে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা বড় ট্রাক ২০০ টাকা ও কাভার্ডভ্যান ১২০ টাকা চাঁদার বিনিময়ে মূল সড়কে রাখার সুযোগ শ্রমিক নেতারা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ফলে আবারও যানজটের মহাবিড়ম্বনায় পড়েছেন যাত্রীরা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মরহুম মেয়র আনিসুল হকের প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সড়কটির ওপর থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে পার্কিংমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়। এর পর শ্রমিকরা সড়কের ওপর থেকে ট্রাক সরিয়ে ভেতরে টার্মিনালে রাখতে শুরু করে। নগরবাসীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এমনকি অবৈধ পার্কিং ঠেকাতে ডিএনসিসি মরহুম মেয়র আনিসুল হকের তত্ত্বাবধানে সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত এলাকার দেয়ালজুড়ে বিউটিফিকেশনে’রও কাজ হয়েছে। দেয়ালজুড়ে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিম্ন স্থাপনা ও ঐতিহ্যবাহী ঘটনাবলির ছবি স্থাপনের জন্য সড়কের দু’পাশের দেয়াল রঙ করা হয়েছিল। তেজগাঁও সাতরাস্তার এই সড়কটি ট্রাকমুক্ত করার তার সেই মহতি উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। সেই সড়কটি আবারও ট্রাকস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে সকাল, বিকাল ও রাতের বেলায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই সড়কটি এখন ট্রাকের দখলে। তেজগাঁওয়ে ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও এসব যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে মূল সড়কেই। তিন লেনের প্রশস্ত সড়ক থাকলেও ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের কারণে মাত্র একটি সরু লেন দিয়েই চলাচল করতে হয় অন্যান্য যানবাহনগুলোকে। দিনের বেলায় অল্প কিছু ট্রাক সড়কটির ওপর দেখা যায়। তবে, রাত যত বাড়ে, সড়ক দখল করা ট্রাকের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে এসব ট্রাক চলে আসে সাতরাস্তা মোড় থেকে মহাখালীগামী মূল রাজপথের ওপরেও। ঢাকা শহরে বিভিন্ন স্থানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চললেও এর দিকে কারো নজর নেই, কেন এ প্রশ্ন সবার মনে।
রাস্তা ট্রাকের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি ট্রাকের চালক ও শ্রমিকদের জন্য ফুটপাথের ওপর গড়ে উঠেছে অন্তত অর্ধশতাধিক টং দোকান। ট্রাকের আড়াল ও দোকানের ফুটপাথ দখলের কারণে রাতে সড়কটি দিয়ে হাঁটাচলা করতে হয় অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে। ছিনতাইকারী এবং মাদকসেবীদের এক অভয়রাণ্যে পরিণত হচ্ছে।
কাওরান বাজারে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইফুর রহমান বলেন, রাতে অফিস শেষে সাতরাস্তা মোড়ে এসে বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে উঠি। কিন্তু, সড়কের উপর ট্রাক রাখার কারণে সড়কে যানজট লেগে থাকে। তাই, রিকশা থেকে নেমে হেঁটেই মোড় পর্যন্ত যেতে হয়। কিন্তু, ফুটপাথে গেলে একেবারে ট্রাকের আড়ালে পড়তে হয়। এতে বেশ ভয় লাগে। এখানে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম এই সড়কটির দখল নিয়ন্ত্রণ করেন। তার তত্ত¡াবধানে সড়কের ওপর রাখা হয় এসব যানবাহন। এর জন্য প্রতি ট্রাক থেকেই মাসোহারা যায় তার পকেটে।
সড়কটি ফের বেদখল হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে অভিযোগ এসেছে, সড়কটি দখল হয়েছে। কিন্তু, গত কয়েক মাস ডেঙ্গুসহ নানা ইস্যুতে ব্যস্ত থাকার কারণে এদিকে একটা নজর দিতে পারিনি। এখন এই বিষয়টি দেখছি। সাতরাস্তা এলাকার সড়কে যারা ট্রাক রাখেন তাদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমার কথা হয়েছে। আমরা অবশ্যই সড়কটি দখলমুক্ত করব।
গতকাল তেজগাঁও এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভ‚মি ও জরিপ অধিদপ্তরের সামনের সড়কজুড়ে রাখা হয়েছে ট্রাক। একটি সড়কদ্বীপের তিনপাশে সড়ক এবং দু’পাশেই ট্রাক রেখে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে আলাউদ্দিন নামের এক ট্রাক চালক বলেন, ভেতরে জায়গা না থাকায় সড়কে ট্রাক রেখেছেন তিনি। উচ্ছেদ হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই আবার সড়কে ট্রাক রাখা শুরু করেছেন তারা। আলাউদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ মাঝেমধ্যে ঝামেলা করলে নেতারা পুলিশকে ম্যানেজ করে, ট্যাকাটুকা দেয়। তাইলে পুলিশ আর কিছু বলে না।’
ভ‚মি ও জরিপ অধিদপ্তরের প্রধান ফটক থেকে বিজি প্রেস স্টাফ কোয়ার্টার, সিএসডি গুদামের ২ নম্বর গেইট, সিএসডি ভাঙা গেইট মোড় হয়ে পুরনো এফডিসি সড়কের পুরোটাই এখন ট্রাকের দখলে। মাঝে যে জায়গা আছে তাতে একটি গাড়ি বা রিকশা কোনোমতে চলতে পারে। তবে দুটি যান পাশাপাশি গেলে আটকে যায়। ফলে ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান বিজি প্রেস স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা নাজমুল। তিনি বলেন, পুরো রাস্তা তারা আবার দখল করে নিয়েছে। আমাদের বাসা থেকে বের হতে, বাসায় ঢুকতে ঝামেলা হয়। গাড়ি ঢুকতে তো সমস্যা আরও বেশি। আর ট্রাকের চালক-হেলপারদের অনেকে সবার সামনে মাদক সেবন করে। সরকারি বাসায় থাকি, ছাড়তেও পারি না।
সিএসডি ভাঙা গেইট থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সড়কও চলে গেছে ট্রাকের দখলে। সড়কের এসব অংশে ট্রাক রাখার পাশাপাশি বিকল যানবাহন মেরামতও করা হচ্ছে। পুরো সড়কে জমে আছে কালিঝুলি। অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। এ সড়কে হেঁটে চলারও উপায় নাই। রেলক্রসিংয়ের কাছে সড়কেই ট্রাক রেখেছিলেন মনোয়ার হোসেন নামের এক চালক। তিনিও বললেন, নির্ধারিত স্থানে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় রেখেছেন। সাতরাস্তা মোড়ে এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির উল্টো দিকে, তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের সামনে এবং রেলক্রসিংয়ের আগে সড়কের পাশে এক সারি করে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মদিনা মসজিদ মার্কেটের সামনে দিয়ে উত্তর দিকে যাওয়ার সড়কটি পুরোটাই দখল করে নিয়েছে বিকল ট্রাক মেরামতকারীরা।
ওই সড়ক ঘুরে দেখা যায়, ট্রাক রেখে ইঞ্জিনের কাজ, দুর্ঘটনার শিকার যানবাহন মেরামত, নতুন ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের বডি সংযোজন সবই সেখানে করা হচ্ছে। এই সড়কটিও পথচারীদের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সাতরাস্তা থেকে আজমেরি মোড়, সেটেলমেন্ট প্রেসের পাশ দিয়ে এফডিসি মোড়ের দিকে যাওয়ার সড়কে বহু ট্রাক-পিকআপ ভ্যান রেখে দেয়া হয়েছে। একই অবস্থা দেখা গেছে সাতরাস্তা থেকে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের পাশ দিয়ে দক্ষিণ বেগুনবাড়ি যাওয়ার সড়কে। এ সড়কের অর্ধেকের বেশি অংশ ছোট ট্রাকের দখলে। আকিজ সিএনজি কনভার্শন সেন্টারের সামনে একটি ট্রাক রেখে তা পরিষ্কার করছিলেন চালকের সহকারী খোকন মিয়া। সড়কে ট্রাক রাখার কারণ জানতে চাইলে খোকন বলেন, ‘তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে সব বড় ট্রাক রাখা হয়। পিক-আপ ও ছোট ট্রাকগুলো বাইরে রাখা হয়। ‘এই সড়ক তো তিন টনি, দেড় টনি টেরাকের স্ট্যান্ড। আমরা এইহানেই গাড়ি রাহি। তয় মেইন রাস্তায় রাখলে পুলিশ আইয়া মাঝে মাঝে ঝামেলা করে, মামলা দিয়া দ্যায়। হের লাইগ্গা পুলিশ আইলে গাড়ি সরাইয়া এই রাস্তায় নিয়া আহি। এইহানে থাকলে কিছু কয় না।’
বিজি প্রেস ও বিআরটিসি কেন্দ্রীয় ট্রাক ডিপোর পাশের সড়ক, বিজি প্রেস ও ইস্টার্ন টিউবের রাস্তা, বিজি প্রেস উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা, তেজগাঁও কলোনি বাজার সড়কের পরিস্থিতিও মোটামুটি এক। আর রাতে তিব্বত বাসস্ট্যান্ড থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত সড়কেও শতশত ট্রাক রাখা হয়। সকাল পর্যন্ত সড়কজুড়ে থাকে এসব যানবাহন।
বাংলাদেশ ট্রাক, কভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান বলেন, মূল সড়ক থেকে ট্রাক সরানো গেলেও জায়গা না থাকায় আশপাশের সড়কে চালকরা ট্রাক রাখছেন। চালকদের তারা সেখান থেকে সরাতে পারছেন না। আমরাও অনেক চেষ্টা করেছি সড়কটা ক্লিয়ার করার। কিন্তু জায়গা না দিলে তারা যেতে চায় না। আমাদের বলেছিল গাবতলীতে একটা ট্রাকস্ট্যান্ড করে দেবে। সেটারও কোনো খবর নেই। রাজধানীতে পরিকল্পিত কোনো ট্রাক টার্মিনাল না থাকার কারণেই এ অবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রুস্তম আলী।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, রাস্তাগুলো আবার অবৈধ দখলে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তিত। তিনি বলেন, আমরাও মাঝেমধ্যে দেখি সেখানে আড়ালে-আবডালে রাখে। আবার আমরা যখন একটু নড়েচড়ে বসি, পুলিশকে বলি তখন তারা চলে যায়। এই লুকোচুরির মতো আরকি। আমরা আবারও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে বিষয়টি জানাব। ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে গাবতলীতে নেয়ার উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, তেজগাঁওয়ের কিছু ট্রাক গাবতলীর আমিনবাজারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে আমাদের একটি ট্রাকস্ট্যান্ড আছে। সেটার পরিধি আরও বাড়ানোর কথা ছিল, যেন সেখানে আরও বেশি ট্রাকের জায়গা দেয়া যায়। দেখি আমরা এবার সেটা নিয়ে কাজ শুরু করব।

 



 

Show all comments
  • ahammad ২৩ নভেম্বর, ২০১৯, ২:১৬ এএম says : 0
    আরে ভাই টাকাপেলে সবাই অন্দহয়ে হয়ে যায়। হয়রে কোপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্দ এইআর কি ??
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ