Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিস্ফোরণ নিয়ে বিতর্ক

বন্দরনগরীর পাথরঘাটায় শোক আতঙ্ক : ভবন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটার বড়–য়া ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে বিতর্ক চলছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ বলে দাবি করা হলেও তা মানতে নারাজ কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিী লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। তাদের দাবি, গ্যাস লাইনে লিকেজ ছিল না, চুলাও অক্ষত আছে। ভবনের নিচতলার কক্ষের ভেতরে থাকা সেফটিক ট্যাঙ্কে জমা গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে দাবি করেন কর্ণফুলী গ্যাসের কর্মকর্তারা। তবে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত সমন্বিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, তদন্ত শেষে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এদিকে ভবনে বিস্ফোরণে সাতজন নিহতের ঘটনায় পুরো এলাকায় এখনও শোকের ছায়া। থামছে না নিহতের স্বজনদের আহাজারি। হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আহত ১০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎকেরা। গতকাল সোমবারও ওই ভবনকে ঘিরে ছিল উৎসুক অগণিত মানুষের ভিড়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বিভীষিকাময় সে বিস্ফোরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে উঠছিলেন। ভবন মালিকের অবহেলার কারণেই এমন দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি ঘটেছে বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা বলছেন, ব্রিকফিল্ড রোডের নকশা বর্হিভূত ওই ভবনটি ছিলো রীতিমত গ্যাস চেম্বার। ছোট্ট একটি জায়গায় গ্যাস লাইনের রাইজার, রান্নাঘর আর সেফটিক ট্যাঙ্ক মিলে ভবনের নিচতলাটিই ছিল বিপদজনক। এ কারণে বিস্ফোরণে উড়ে গেছে ভবনের নিচতলার সামনের পুরো অংশ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশপাশের আরও দুটি ভবন। এ ভবনের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকায় আরও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থাকায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা বলছেন, যে কোন সময় আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

রোববার সকালে ভবনের নিচতলার বাসিন্দা সন্ধ্যা রাণী নাথ পূজোর জন্য মোমবাতি জ্বালাতে দিয়াশলাই ধরাতেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ঘটনা তদন্তে গঠিত চারটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। কমিটির সদস্যরা গতকাল ভবনটি পরিদর্শন করেন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য শুনেন।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা দেখেন চারতলা এই ভবনটি গড়ে উঠেছে একেবারে রাস্তার গা ঘেষে। নিচতলায় গ্যারেজের জন্য রাখা জায়গায় কক্ষ বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়। নকশাবর্হিভ‚ত নির্মাণ করতে গিয়ে সেফটিক ট্যাঙ্ক এবং গ্যাস লাইন নিচতলার কক্ষের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিস্ফোরণটি ঘটেছে নিচতলার একটি বাসার কোন এক জায়গা থেকে। বাসাটির রান্নাঘরের পাশেই ছিল গ্যাস সরবরাহ লাইনের রাইজার। আর সামনে পুরো অংশজুড়ে ছিল সেফটিক ট্যাঙ্ক।

বিস্ফোরণে রান্নাঘরের দেয়াল যেমন উড়ে গেছে, তেমনি উড়ে গেছে সেফটিক ট্যাঙ্কের মুখও। ফলে বিস্ফোরণের কারণ নিয়েও সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। কারণ গ্যাসের লাইন এবং রাইজার ছিলো পুরোনো।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বিস্ফোরণের জন্য গ্যাস লাইনের ত্রুটিকে দায়ী করেন। অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ভবনের রাইজার ও পাইপ লাইন খুব পুরনো। পাইপ লাইন রাবার দিয়ে মোড়ানো ছিল না, আমরা ধারণা করছি, পাইপ লাইনের কোনো ফুটো দিয়ে গ্যাস বের হয়েছে। যেহেতু পাশে দেয়াল ছিল তাই গ্যাস রুমের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। আহত একজন স্বীকার করেছেন ঘরে দিয়াশলাই জ্বালিয়েছেন। এতে আগুনের উৎস পেয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে।

সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, সেফটিক ট্যাঙ্ক যদি যথার্থভাবে ডিজাইন করা না হয় তবে সেখান থেকেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, কারণ সেখানে বিপদজনক গ্যাস জমা হয়। তারপরেও গ্যাসের যে রাইজারগুলো দেখছি, সেগুলো বিপদজনক অবস্থায় ভবনের ভেতরে ছিল।

তবে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খায়ের আহমেদ মজুমদার দাবি করেন, দুর্ঘটনা গ্যাস লাইন থেকে হয়নি এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি বলেন, গ্যাসের রাইজার, ওই বাড়ির চুলা এবং গ্যাস লাইন অক্ষত পেয়েছি। রান্নাঘরেও কোনো সমস্যা হয়নি। এ থেকে আমরা নিশ্চিত দুর্ঘটনা গ্যাসের কারণে হয়নি।

তদন্ত কমিটির প্রধান কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) সারোয়ার হোসেন বলেন, গ্যাসের বিস্ফোরণ হলে ব্যাপক অগ্নিকান্ড হতো, তা হয়নি। সকালে ওই বাসার রান্নাঘরের চুলায় চা বানানো হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। ওই ভবনের বাউন্ডারির ভেতরে একটি সেফটিক ট্যাঙ্ক আছে সেখান থেকে হয়েছে কি না সেটা দেখা উচিত।

অপরদিকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ জে এম শরিফুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে তদন্ত শুরু করেন। কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সদস্য করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ জে এম শরিফুল হাসান জানান, সব সংস্থার প্রতিনিধিকে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। নগর পুলিশের পক্ষ থেকে গঠিত আরেকটি তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এসময় ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইসমাইল বালি, কোতোয়ালী থানার ওসি মো. মহসীনসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

ভবন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা
বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় ভবনটির মালিক দুই ভাইকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত রিকশা চালক মাহমুদুল হকের স্ত্রী শাহিনা আক্তার বাদী হয়ে গতকাল এ মামলা করেন। থানার ওসি মো. মহসীন বলেন, মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত হত্যা ও আহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় বাড়ির মালিক দুই সহোদর অমল বড়ুয়া ও টিটু বড়ুয়াসহ আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন দুই ভাই। ওসি জানান, তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ