পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সরকারি অর্থে পরিচালিত দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিতর্কিত মহাপরিচালক অনিয়ম ও দুর্নীতির সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও খ্যাতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে দেশবাসি তা কল্পনাও করেনি। অভিজ্ঞ মহল এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) গত ১০ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। চলতি বছরের ৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত এই নিরীক্ষা চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশেষ অডিট টিমের অনুসন্ধানে ইফার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উপাত্ত উঠে এসেছে এমন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে স¤প্রতি তড়িঘড়ি করে কয়েক দফায় মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের অব্যয়িত ৭৪ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়া হয়েছে। আরো কিছু অব্যয়িত টাকা ফেরত দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজালের মেয়াদকালে (প্রায় ১০ বছর) এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটে। ইফার কাছে এসব অনিয়মের জবাব চেয়েছে নিরীক্ষা দল। নির্ভরযোগ্য সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
ইসলামের প্রচার ও প্রসারের সুমহান লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এক অধ্যাদেশ বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রকাশনা গবেষণাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা ছিল ঈর্ষণীয়। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও বর্তমানে বিশ্বে বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী বিশ্বকোষ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকেই।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী পদ হলো মহাপরিচালক। বিভিন্ন সময় এ গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে দেশের সেরা ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকদের। সাবেক ইসলামী একাডেমীর ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন আল্লামা আবুল হাশিম, ড. মঈনুদ্দিন খান, এ,জেড,এম শামছুল আলম কিংবা সৈয়দ আশরাফ আলীর মত ইসলামী চিন্তাবিদ ও পন্ডিতবর্গ। কিন্ত এবারই প্রতিষ্ঠানটিতে একজন মহাপরিচালক দেয়া হয়েছে যিনি সবচেয়ে কম পড়াশুনা জানা ব্যক্তি এবং যার নৈতিকতার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ের।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মো. আফজালের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রসমূহে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কখনো কোন তদন্ত হয়নি। তদবির ও লবিংয়ে পারদর্শী মহাপরিচালক উপর মহলে বুঝাতেন যে, এসব জামাত-শিবিরের কারসাজী। কিন্ত এবার খোদ সরকারের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় উঠে এসেছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ আত্মসাতের এক ভয়াবহ চিত্র।
এতে বলা হয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা কেন্দ্রের জন্য পাঠ্যবই মুদ্রণে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ২০ কোটি ৯৮ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৭ টাকা এবং পবিত্র কোরআনুল কারিম মুদ্রণে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে অতিরিক্ত মূল্যে কার্যাদেশ দেয়ায় ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ৪১৭ টাকা ক্ষতি হয়েছে। কার্যাদেশের পরিমাণের চেয়ে কম কোরআন শরিফ নেয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৩২ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা। বোগদাদিয়া কায়দায় ক্ষতি এক কোটি টাকা। জিওবির বরাদ্দের অব্যয়িত টাকা জমা না দেয়ায় ২২ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার ৫০৯ টাকা ও সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন ছাড়াই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানকে ১৬ কোটি ৩০ লাখ ১০০ টাকা দেয়া হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে বিধিবহির্ভূত নিয়োগ ও পদোন্নতি, প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ ফেরত না দিয়ে বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন, কেনাকাটায় অনিয়ম, অনুমোদন ছাড়া পেনশন ফান্ডে টাকা স্থানান্তরসহ ইফার বিভিন্ন কার্যক্রমে নানা অপকর্মের অভিযোগ ওঠে।
এমন পরিস্থিতিতে ইফার যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করতে চলতি বছরের ৮ জুলাই পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ নিরীক্ষা দল গঠন করে সিভিল অডিট অধিদফতর। ইফার প্রকল্প পরিচালক ফারুক আহম্মেদ বলেন, তিনি দু-তিন মাস হল প্রকল্পে যোগ দিয়েছেন। আগের কর্মকর্তারা কী কারণে মোটা অঙ্কের অব্যয়িত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেননি তা বোধগম্য নয়। তবে তিনি এ ব্যাপারে সচেতন। নিয়ম মেনে আরও টাকা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২০০৯ সাল থেকে ইফার ডিজির দায়িত্ব পালন করে আসছেন বিচার বিভাগের কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজাল। এ সময়ে দুই দফা তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অনুসন্ধানে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকায় ইফার ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের নাম এসেছে। তার নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ রয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইফার একাধিক কর্মকর্তা জানান। ইফা ডিজির ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সাবেক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজাল ১০ বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত। গত জুনে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ধর্ম মন্ত্রণালয় ডিজিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় আলোচনায় আসে। ওই শোকজ নোটিশে অনিয়মের অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়। পরে অবশ্য ইফা বোর্ড কিছুটা নমনীয় হয় এবং ডিজির কিছু ক্ষমতা কমিয়ে তার চুক্তির মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্ব অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।
মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ইফা ডিজির অনিয়মের বিষয় সামনে আসার পরই গত জুলাই মাসে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রমে হাত দেয়া হয়। অডিট অধিদফতরের উপ-পরিচালক এসএম নিয়ামুল পারভেজের নেতৃত্বে এই টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্স অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শফিকুল ইসলাম, অডিটর মো. মফিজুল ইসলাম এবং মো. ইমাম হোসেন। এই অডিট টিম এক মাসের নিরীক্ষায় ইফার বিভিন্ন প্রকল্পসহ ব্যয়ের অনেক খাতেই অনিয়ম ধরা পড়ে। ১৮৬ পৃষ্ঠার প্রাথমিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ১৩৪টি খাতে অনিয়মের চিত্র এসেছে।
বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সরাসরি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এমন খাতগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল, আর্থিক বছরের শেষ দিনে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে ৬৪ জেলায় অর্থ ছাড় করা হয় ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ২২০ টাকা; যা অনিয়ম। আর্থিক বছর শেষে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে না দেয়ায় ক্ষতি ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৭৩ টাকা।
অব্যয়িত পুঞ্জীভূত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়ায় ক্ষতি ৯৯ কোটি এক লাখ ৬ হাজার ৭৪৪ টাকা। প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা ইফার স্থায়ী ফান্ডে আমানত করায় সরকারের ক্ষতি ৪৬ কোটি ৩৩ লাখ ৭ হাজার ৫৬৩ টাকা, বিধিবহির্ভূত ৪৭ জনকে প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগ দেয়ায় ক্ষতি ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬০ টাকা। একইভাবে আরও ১৬৭ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়ায় ক্ষতি প্রায় ৮ কোটি টাকা।
দৈনিকভিত্তিক কর্মচারীদের রাজস্ব পদে স্কেলভিত্তিক নিয়োগ দেয়ায় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ হাজার ৯৯৮ টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং দারুল আরকাম মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বরাদ্দের টাকা রেখে দেয়ায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ৫১৮ কোটি টাকা তসরুফ করা হয়েছে। এসব খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ১৩৭ কোটি ৬৬ লাখ ২০ হাজার ৮৫৭ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ইফার পেনশন ফান্ডে ১৪১ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩৮ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। অন্য একটি খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। ডিপিপিতে বরাদ্দের চেয়ে জেলা অফিসগুলোতে অতিরিক্ত অর্থ ছাড় করা হয়েছে ১৪ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ডিপিপির অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে ২৬ কোটি ১৪ লাখ ৫ হাজার টাকা। আর্থিক ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রেসের কাঁচামাল কেনা হয়েছে ৪৫ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৬ টাকা, বিধি লঙ্ঘন করে দৈনিকভিত্তিক কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়েছে দেড় কোটি টাকা।
অগ্রিম পরিশোধ করা প্রায় দেড় কোটি টাকা সমন্বয় করা হয়নি। এছাড়া ক্রয়সীমার বাইরে খরচ করা হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। বহির্ভূতভাবে একটি ব্যাংকে রাখা হয়েছে ২৯ কোটি ৪৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ টাকা। বিধিবহির্ভূতভাবে একটি প্রকল্পের ফিল্ড সুপারভাইজারদের বেতন-ভাতাদি দেয়া হয়েছে সাড়ে ১১ কোটি টাকা। অনুশীলন ও ড্রয়িং খাতা মুদ্রণ বাবদ অব্যয়িত প্রায় ৬ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি।
ইফার নিজস্ব ডিজিটাল প্রেস থাকার পরও বাইরের প্রেস থেকে প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি ছাপানোয় ৩৬ কোটি ৫৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৬ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণার অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সিডি ভ্যাটের অব্যয়িত দেড় কোটি টাকাও জমা দেয়া হয়নি। বায়তুল মোকাররমের দোকান ভাড়ার ২ কোটি ৬১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা অনাদায়ী রয়েছে। অনুমোদন ছাড়া ৩ কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়ায় পরিশোধ করতে হয়েছে এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এছাড়া ইফা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।