পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সাদেক হোসেন খোকা। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। সাবেক মন্ত্রী। অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ সাবেক মেয়র। কিন্তু সব পরিচয় ছাপিয়ে খোকা খ্যাতিমান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়র থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করে তা কখনও দেখেননি খোকা। একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়। মুক্তিযুদ্ধে সফল এই গেরিলা যোদ্ধা জীবন-যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গতকাল সোমবার দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল ¯েøায়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তোকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন।
জন্ম ও পরিবার: দেশের জন্য যুদ্ধ করা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৫২ সালের ১২ মে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। খোকার স্ত্রী ইসমত হোসেন, মেয়ে সারিকা সাদেক, ছেলে ইশরাক হোসে ও ইশফাক হোসেন।
ইশরাক হোসেন পেশায় প্রকৌশলী। তিনি যুক্তরাজ্যের হার্ডফোর্ড শেয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শেষ করেছেন। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির অন্যতম সদস্য।
শিক্ষা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নত ছিলেন। সেই অবস্থায় পরিবারের কাউকে না জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা আসলে সাদেক হোসেন খোকা পরিবারের অন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই গোপনে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে গোপনে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যেসব স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল, ১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদসহ (বুড়া) বেশ কয়েকজন মিলে প্রথমে খোকা’রা যান নরসিংদীর শিবপুরে। ওখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য আগরতলার পৌঁছলে তাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল (রাশেদ খান মেননের ছোট ভাই)। সেখান থেকে প্রথমে বটতলাস্থ সিপিএম অফিসে গিয়ে চলে চলে যান দুই নাম্বার সেক্টরে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। মেজর হায়দারের (পরে কর্নেল হায়দার) নেতৃত্বে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। দুই নাম্বার সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’। মেলাঘরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। পাহাড় আর ঘনজঙ্গলে পূর্ণ ছিল চারিদিক। লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ একটু বৃষ্টি হলেই বেশ পিচ্ছিল হয়ে পড়তো। এ ক্যাম্পে বেশিরভাগই ছিল ঢাকা শহরের ছেলে, এ রকম পরিবেশে থাকতে তারা অভ্যস্ত ছিল না।
তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মরহুম মেসবাহ উদ্দিন সাবু এক সঙ্গে থাকতেন। মেজর হায়দারের অধীনে তিন সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিং শেষে তারা সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন গাফফারের (পরে জাতীয় পার্টি নেতা ও মন্ত্রী) নেতৃত্বাধীন সাব সেক্টরে। ওখানে ট্রেনিং শেষ করার পর প্রথমদিকে কসবা-মন্দভাগ (মির্জাপুর) যুদ্ধের নয় মাসই প্রতিদিন এক বা একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সাদেক হোসেন খোকার ্রমুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালি দিনগুলোগ্ধ প্রবন্ধে নিজেই লিখেছেন, ্রমুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা ভাবলেই নস্টালজিক মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মন শুধু রণাঙ্গনের সাহসী সহযোদ্ধাদের হারানোর কারণেই ভারাক্রান্ত হয় না, তার চেয়েও বেশি হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনার দুর্দশা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বপ্ন যাই বলি না কেন সেটা শুধু একটি ভূখন্ডের স্বাধীনতা নয়, একটি সার্বিক মুক্তিই ছিল এ মহান যুদ্ধের মূল স্পিরিট। সে কারণেই এর নাম হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন: ১৯৮০’র দশকে সাদেক হোসেন খোকা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে যোগদান করেন। অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতিসহ দলের গুরুত্বপ‚র্ণ দায়িত্ব পালন করেন খোকা। ৯০’র দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন খোকা। পুরান ঢাকার নয়াবাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটে বিএনপির কার্যালয় থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন ৭ দলীয় জোটের নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই কঠোর আন্দোলনের ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহবায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন খোকা। বিভিন্ন সময় আন্দোলনে রাজপথের এই রাজনীতিবিদ প্রতিপক্ষের হামলায় রক্তাক্তও হোন।
১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু স¤প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন খোকা। এতে তিনি পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে ঢাকা-৭ আসনে (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) বিশাল ব্যবধানের আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবার এমপি হন সাদেক হোসেন খোকা। বিএনপির সরকার গঠন করলে খালেদা জিয়া তাকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকাই নির্বাচিত হন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিএনপির গুরুত্বপ‚র্ণ নেতায় পরিণত হন। সেসময় ঢাকার রাজপথে রক্তে রঞ্জিত খোকার ছবি এখনও অনেকের চোখেই দৃশ্যমান। ২০০১ সালেও একই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ। ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি সরকার গঠন করলে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় বর্ষিয়ান এই রাজনীতিবিদকে।
২০০২ সালে ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেন তিনি। ২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন খোকা।
সামাজিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন: রণাঙ্গণের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি, কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি শুধু রাজনীতিতে নন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরেই ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খোকা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন। জনবান্ধব নেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল খোকার। পুরান ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ খোকাকে তারা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাশে পেতেন। যখনই ডাক পড়েছে, তখনই তিনি ছুটে গেছেন পুরান ঢাকাবাসীর কাছে। এজন্য তিনি পেয়েছেন ঢাকাবাসীর বিপুল সমর্থন।
শেষ আক্ষেপ: দীর্ঘদিন যাবত তিনি কিডনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৪ মে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মুক্তিযুদ্ধের এই গেরিলা যোদ্ধা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ¯েøায়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ২০১৭ সালে নবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন বিএনপির এই ভাইস-চেয়ারম্যান। কিন্তু বার বার আবেদন করেও ‘ওপর মহলের’ অযুহাতে খোকা ও তার স্ত্রীর পাসপোর্ট দেয়নি দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। খোকার শেষ ইচ্ছে ছিল- যে মাটির জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সেই মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার। কিন্তু পাসপোর্ট আটকে থাকায় শেষ ইচ্ছার আক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশ সময় সোমবার দুপুর দেড়টায় যুক্তরাষ্ট্রেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।#
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।