Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেড় লাখ টন চাল কম উৎপাদনের শঙ্কা

দক্ষিণাঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততা ও বালুমিশ্রিত পানি

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সদ্য বিদায়ী বর্ষা মৌসুমেও এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পাওয়ায় নদ-নদীতে উজানের প্রবাহ হ্রাস পেয়ে উপকূলীয় নদ-নদীর মোহনা ছাড়িয়ে লবনাক্ততা ক্রমশ: উত্তরে উঠে আসছে। সীমান্তের ওপারের অত্যধিক বালু মিশ্রিত পানি এসে দেশের অভ্যন্তরিণ নদ-নদীর তলদেশ ভড়াট করে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি করছে। এমনকি বলেশ^রের মত বড় মাপের নদীর পদ্মার সংযোগস্থলের উৎসে চর পড়ায় প্রবাহ হ্রাস পেয়ে সাগর মোহনার পাথরঘাটার লবনাক্ততা ইতোমধ্যে পিরোজপুরের নাজিরপুর পর্যন্ত পৌছে গেছে। ফলে কৃষি-সেচসহ আবাদেও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় কৃষি বিশেষজ্ঞগণ। আবহাওয়াু পরিবর্তনে বৃষ্টির অভাবে এবার দক্ষিণাঞ্চলে আমন ও আউশ উৎপাদন অন্তত: দেড় লাখ টন হ্রাস পাচ্ছে।

বৃষ্টির অভাবে এবার দক্ষিণাঞ্চলে আউশ আবাদ আশঙ্কাজনহারে হ্রাস পেয়েছে। অথচ সরকার বোরোর পরিবর্তে আউশ আবাদ উৎসাহিত করছে। সারাদেশে মোট আউশের ২০%-এরও বেশি আবাদ ও উৎপাদন হয়ে আসছিল। এ অঞ্চলের মূল দানাদার খাদ্য ফসল আমন আবাদ লক্ষমাত্রা অর্জিত হলেও তা গত বছরের মূল আবাদের চেয়ে কম। আবার মূল মৌসুমে বৃষ্টির অভাবে শরৎকালীন শাক-সবজি ক্ষতির কবলে পড়েছে, অক্টোবরের শেষে অসময়ের অতিবর্ষণে আগাম শীতকালিন সবজিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে এবার শীতকালীন শাক-সবজির আগমন বিলম্বিত হবার আশঙ্কাও রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, গত জুন মাসে বরিশালে স্বাভাবিক ৪০৮.৪ মিলিমিটারের স্থলে বৃষ্টি হয়েছে ১৪৮ মিলিমিটারের মতো। জুলাই মাসে ৪০৭.৩ মিলিমিটারের স্থলে সামান্য কিছু বেশি বৃষ্টি হলেও আগষ্ট মাসে ৩৭১.৩ মিলিমিটারের স্থলে ২৬০ মিলিমিটারের চেয়েও কম বৃষ্টি হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ২৫৯.৪ মিলিমিটারের স্থলে বৃষ্টি হয়েছে ১৭৯ মিলিমিটার। তবে বর্ষা মাথায় করে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বিদায় নিলেও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে গত কয়েকদিন ধরে অসময়ের অতিবর্ষণে চলতি অক্টোবরে ১৫৮.৬ মিলির স্থলে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বরিশালে বৃষ্টি হয়েছে ১৭৫ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে অসময়ের এ বর্ষণ রোপা আমন ও বোনা আমনের জন্য কিছুটা উপকারি হলেও শীতকালিন সবজিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
গত বছর এপ্রিল ও মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টি হলেও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা ছিল কম। বিগত গ্রীষ্ম মৌসুমে বরিশালে তাপমাত্রা ৩৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গিয়েছিল। অথচ এ অঞ্চলে সারা বছরের মধ্যে এপ্রিলেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকার কথা। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে তা উঠে গেছে ৩৩-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
বৃষ্টির অভাবে এ অঞ্চলের দ্বিতীয় দানাদার খাদ্য ফসল বোরো ধানে সেচের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় যেমনি বাড়ছে, তেমনি ভূগর্ভস্থ ও উপরিস্থিত পানির ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর ক্রমশঃ নিচে নামছে।

মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর দায়িত্বশীল সূত্রমতে পদ্মা ও মেঘনার পানি দক্ষিণাঞ্চলের বড় নদ-নদীগুলোই সাগরে নিয়ে যায়। কিন্তু উজানে বৃষ্টির অভাবে উৎসে নাব্য সঙ্কটে প্রবাহ ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সাগরের লোনাপানি উজানে উঠে আসার সুযোগ বাড়ছে। তবে মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৯-’১০ এর পরে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা নিয়ে তেমন কোন জরিপ পরিচালনা করেনি। ২০১৩-১৪ সালে উপকূলীয় ১৮ জেলায় একটি জরিপ পরিচালিত হলেও তার ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। তবে একটি অসমর্থিত সূত্রমতে ২০১৩ সালের ঐ জরিপে দক্ষিণাঞ্চলের আবাদযোগ্য প্রায় ৮.১৪ লাখ হেক্টর জমির প্রায় ৪০%ই লবণাক্ততার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানা গেছে। অপর এক সূত্রমতে ১৯৭৪ সালের পরে দেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ প্রায় ৩৬% বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে বৃষ্টির অভাবে এবার খরিপ-১ মৌশুমে দক্ষিণাঞ্চলে আউশ আবাদে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সারা দেশে ১১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টরের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে ২ লাখ ১১ হাজার ৫৪৪ হেক্টরের আউশ আবাদে লক্ষ্য স্থির করলেও বাস্তবে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫২৫ হেক্টরে আউশ আবাদ হয়। যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৫.৮১%। অথচ গত বছর ২ লাখ ৬ হাজার ৬২৭ হেক্টর আবাদ লক্ষমাত্রার বিপরীতে এ অঞ্চলে ২ লাখ ১১ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্য ৪ লাখ ৩০ হাজার টন অতিক্রম করে ৫ লাখ ১৪ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়। মূলতঃ বৃষ্টির অভাবে এবার আউশ আবাদে বিপর্যয় ঘটে বলে মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগণ জানিয়েছেন।

অপরদিকে সদ্য সমাপ্ত খরিপ-২ মৌসুমে আমন আবাদ গত বছরের তুলনায় কম। এবার বৃষ্টির অভাবে আমন বীজতলা তৈরিতে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ফলে গত বছরের ৭ লাখ ২০ হাজার ৩৬৫ হেক্টরের স্থলে এবার দক্ষিণাঞ্চলে আমন আবাদ হয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭শ’ হেক্টরের মত। যা চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও উৎপাদন গত বছরের ১৭ লাখ ৮৪ হাজার টনে পৌছবে না। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় আগেভাগেই চলতি মৌসুমে আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দক্ষিণাঞ্চলে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টনে নামিয়ে রেখেছে। ফলে শুধু আউশ আর আমনেই দক্ষিণাঞ্চলে চলতি বছর প্রায় দেড়লাখ টন খাদ্য কম উৎপাদন হতে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ