পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্পট হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২৪ অক্টোবর, রেশমা বেগম অপেক্ষা করছেন বোনের লাশ গ্রহণের জন্য। বড় বোন আবিরন বেগমকে দুই বছর আগে রিক্রুটিং এজেন্সি ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস সউদী আরব পাঠিয়েছিল। সেখানে নির্যাতনে তিন মাস আগে মারা গেছেন। আরিয়ন বেগমের লাশ যখন গ্রহণ করেন তার পরিবার; তখন রেশমার হৃদয়বিদারক কান্নার দৃশ্য দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
রেশমা জানান, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আবিরন সউদী যাওয়ার পর নিয়োগকর্তার নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তাকে কার্যত বিক্রি করা হয়। ফলে কাজের নামে ধর্ষিত হতে থাকেন। নিরুপায় আবিরন সমস্যার কথা নিয়ে এজেন্সি ও দালালের কাছে গেলে তারা বিভিন্নভাবে হুমকি দেয় পরিবারকে। গত ১৭ জুলাই গৃহকর্তার বাসায় মারা যায় আবিরন। মৃত্যুর ৫১ দিন পর খবর জানতে পারে তার পরিবার। পরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগিতায় দূতাবাস ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে তার লাশ দেশে আনা হয়। আবিরনের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা আছে ‘হত্যা’। তবে সংশিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস (আরএল-১৩২১) দাবি করেছে, আবিরন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আবিরনের লাশ খুলনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় রেশমা বলেন, ‘আমার বোনকে গৃহকর্তা ধর্ষণ করতো; প্রতিবাদ করলেই নেমে আসতো নির্যাতন। ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস আমার বোনকে বিক্রি করে দিয়েছিল।’ শুধু আবিরন নন, বাংলাদেশের শত শত মেয়ে কাজের জন্য বিদেশ গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। চরম দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন; এরই মধ্যে ধর্ষণের নির্মম অভিজ্ঞতা নিয়ে কয়েকশ’ ফেরত এসেছেন। কিন্তু সমস্যা সমাধানের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
‘সউদীতে নারী শ্রমমিক নির্যাতনের কেন সুরাহা নেই?’ ‘যৌন প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তিন দিন খেতে দেয়নি’। ‘সউদী থেকে ফেরার পর পরিবারেও ঠাঁই নেই’। ‘সউদী আরবে নারী শ্রমিকের পরিবেশের পরিবর্তন হচ্ছে’। ‘সউদীতে গ্রহকর্মী হিসেবে গিয়ে দেশে ফিরলেন পঙ্গু হয়ে’। ‘প্রবাসে নারী কর্মী নির্যাতনের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন মন্ত্রী’। ‘সউদীতে নারী কর্মী খুন : এজেন্সি বলছে, ‘আল্লাহই ভালো জানে’। ‘মালয়েশিয়ায় ১০ বাংলাদেশি নারীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগ’। ‘আটজনের কাছে বিক্রি, ধর্ষণ করতো তিনজন’। ‘নারী কর্মীদের নির্যাতনে সউদী আইনে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই’। ‘বিদেশে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না’। ‘তোকে কিনে এনেছি, যা ইচ্ছা করব’- এই শিরোনামগুলো হলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মিডিয়া বিবিসি’র খবরের শিরোনাম। গত কয়েক দিনে প্রভাবশালী মিডিয়াটি এসব খবর প্রচার করেছে। এই খবরগুলো প্রচারের পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সউদী আরবে কাজের জন্য যাওয়া বাংলাদেশের নির্যাতিত নারীদের আর্তচিৎকার কেউ শুনছে না।
বিবিসির ওই শিরোনামগুলোর সত্যতা মেলে গত ২৬ আগস্ট সউদী থেকে ফিরে আসা ১১১ নারীর কথায়। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে একজন নারী শ্রমিক বলেন, ‘বাসায় কাজ দেয়া হয়। প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলতো নির্যাতন। বাসার বাবা এবং ছেলে দু’জনই নির্যাতন করতো। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতে তারা থেমে যেত না। ওই অবস্থাতেই শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা।’ আরেকজন নারী বলেন, ‘আমাকে প্রতি রাতে ৪ থেকে ৮ জন নির্যাতন করতো। কোনো না করার উপায় ছিল না। ‘না’ বললেই নেমে আসতো নির্যাতন। রিক্রুটিং এজেন্সিকে জানালে তারা বলতো দেখছি। আর ওরা বলতো তোমাকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, আমরা কিনেছি; যা খুশি তাই করবো।’ সউদী ফেরত দুই নারীর নির্যাতনের এই বর্ণনায় উঠে আসে বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর পর তাদের চালচিত্র।
গত ২৬ আগস্ট সউদী আরব থেকে দেশে ফেরা দুই নারী এভাবে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। সেদিন তাদের সঙ্গে আরও ১১১ নারী দেশে ফেরেন। তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পরে সেই প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ফেরা ১১১ নারীর মধ্যে ৩৮ জন যৌন নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। এ ছাড়া ৪৮ জন নিয়মিত বেতন-ভাতা না দেয়ায়, পর্যাপ্ত খাবার খেতে না দেয়ায় ২৩ জন, ৪ জন ছুটি না দেয়ায়, মালিক ছাড়া অন্য বাড়িতে কাজ করানোর জন্য ৭ জন, ১০ জন অসুস্থতার কারণে, পারিবারিক কারণে ১ জন, ভিসার মেয়াদ না থাকায় ৮ জন, দুই বছরের চুক্তি শেষ হওয়ায় ১৬ জন এবং অন্যান্য কারণে ২ জন ফিরে আসেন। দেশে ফেরত আসা নারী শ্রমিকরা জানান, সউদী আরবে হাজার হাজার নারী শ্রমিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সে দেশে রাখা হচ্ছে।
যৌন নির্যাতনের শিকার এসব নারীর কথায় ফুটে উঠেছে নির্মম প্রহারের বর্ণনা। তারা বলছেন, সুস্থ মানুষ হিসেবে সউদী যাওয়ার পর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে অসুস্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে। ‘কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো’- প্রশ্ন করেন ওই দুই নারী।
বাসায় কাজ করার সময় বাবা-ছেলের হাতে নিয়মিত নির্যাতিত নারী বলেন, ‘ওই মালিক বলেন, তোকে কিনে এনেছি। তোর সঙ্গে যা ইচ্ছা তা-ই করব। এভাবে প্রতি রাতে আমার ওপর যৌন নির্যাতন করা হতো। কিন্তু একদিন আমি পালিয়ে সউদী পুলিশের কাছে ধরা দেই। আমার কাছে কোনো কাগজপত্র না থাকায় পুলিশ আমাকে জেলে পাঠায়।’ অপরজন বলেন, ‘রিক্রুটিং এজেন্সি আমাকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে সউদী আরবে পাঠায়। প্রথম এক বছর দেড় মাস একটি বাসায় কাজ করি। তারা নিজেদের বাসা ছাড়া আত্মীয়দের বাসায় নিয়েও কাজ করাতো। অথচ তিন বেলা ঠিকমতো খেতেই দিত না। এমনকি এত কাজ করার পরও বেতন পেতাম না। রিক্রুটিং এজেন্সিকে জানানোর পর তারা হোটেলে কাজ দেয়। সে হোটেল যেন দোজখখানা। প্রতি রাতে ৪ থেকে ৮ জন আমার উপর জুলুম-নির্যাতন করে। নতুন মালিক বলল, ‘বাংলাদেশি প্রায় চার লাখ টাকায় তার কাছে আমাকে বিক্রি করেছে।’
অবশ্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে সউদী আরব থেকে নারী শ্রমিকদের ফিরে আসা সম্পর্কে সরকার অবগত। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সর্বশেষ সফরেও দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।
সউদী আবরে নারী শ্রমিকদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের কারণে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপাল সে দেশে নারী শ্রমিক পাঠানো কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের সউদী আরবে যাওয়া বেড়ে গেছে। বৈদেশিক কর্ম সংস্থান ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, মূলত ১৯৯১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়। ওই বছর দুই হাজার ১৮৩ জন নারী শ্রমিক বিদেশ যায়। আর চলতি বছর এই ১০ মাসে গেছে ৭৮ হাজার ৪৫ জন। তবে ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক বিদেশ যাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই যাচ্ছে সউদী আরব। অথচ সউদী আরবে নারী শ্রমিক নির্যাতন এখন ওপেন সিক্রেট। সউদী আরবে ধর্ষিত ও নির্যাতিত হয়ে গত কয়েক দিনে শত শত নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। তারা নিজেদের দুর্দশার চিত্র মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- যে দেশে নারী শ্রমিকের মর্যাদা নেই, সে দেশে কেন নারী শ্রমিকদের পাঠানো হচ্ছে?
এ প্রসঙ্গে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের ব্যাপারে সউদী আরবের মতো দেশকে চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। তিনি বলছেন, আমাদের শ্রম বাজারের একটা বড় জায়গা হচ্ছে সউদী আরবে। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স যখন বলল যে আমরা তোমাদের (সউদী আরব) নারী শ্রমিক দেবো না, গৃহ শ্রমিক দেবো না, তখন সউদী আরব শর্ত দিলো যে বাংলাদেশ থেকে যদি একজন নারী শ্রমিক পাঠানো হয় তাহলে দু’জন পুরুষ শ্রমিক নেবো। স্বভাবতই তখন আমাদের দেশের শ্রমিকরা চিন্তা করেছে, ঠিক আছে আমার যদি পুরুষ শ্রমিক যায়, আর তারা যা বলতেছে যে ফোন ব্যবহার করতে দেবে, ঠিকমতো বেতন দেবে, কোনো রকম অত্যাচার হবে না তখন সরকার রাজি হলো, আমরাও সিভিল সোসাইটি রাজি হলাম।’
সউদীতে কাজ করতে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার প্রাণ হারানো আবিরন বেগমের লাশ গ্রহণের সময় ছোট বোন রেশমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমরা গরিব এ জন্য আমাদের মান-ইজ্জত-সম্ভ্রমের মূল্য নেই। আমার বোন সউদী আরবে কাজের জন্য গিয়ে সম্ভ্রম হারিয়ে প্রাণ দিয়েছে। অথচ সরকার নীরব! ধনীদের কোনো মেয়ের এমন অবস্থা হলে সরকার কি নীরব থাকতো?’ খুলনার অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে রেশমার কথার সূত্র ধরে প্রশ্ন আসে বিদেশে আর কত দিন বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের সম্ভ্রম খোয়াতে হবে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।