Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আসছে বালু মাটি ছাই

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির আড়ালে অর্থপাচার

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্যের বদলে বিদেশ থেকে আসছে কন্টেইনারভর্তি বালু, মাটি আর ছাই। অথচ পণ্য আমদানির বিপরীতে বিদেশে যাচ্ছে ডলার। আবার কখনো কখনো আসছে ফাঁকা কন্টেইনারও। রফতানি পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে বা আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থপাচারের পাশাপাশি এখন ঋণপত্রের পুরো টাকাই বৈধ চ্যানেলে পাচার করার এ কৌশল নেওয়া হচ্ছে। এ কৌশলে, পণ্য আমদানি না করেই বিদেশে অর্থপাচার করে দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন কাস্টম সংশ্লিষ্টরা।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পরই মাঝে মধ্যে এ ধরনের কিছু চালান ধরা পড়ছে। তবে বেশিরভাগ চালানই নিরাপদে চলে যাচ্ছে। বিদেশে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পর্যাপ্ত তদারকির অভাব এবং স্ক্যানিংসহ আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীরা পার পেয়ে যায় বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। গত দুই সপ্তাহে আমদানি পণ্যের আড়ালে বালু-মাটি আনার দুটি ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। গেল পাঁচ বছরে এমন অন্তত ১৫টি বড় ঘটনা ধরা পড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার নুর উদ্দিন মিলন ইনকিলাবকে বলেন, নজরদারির কারণেই এমন চালান ধরা পড়ছে। এসব ঘটনায় বিদেশে অর্থপাচার হয়েছে বলে ধারণা করছি। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচার আইনে মামলা করার সুযোগ আছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তদন্ত দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সময় সাপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্ত শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে মামলা করতে হয়।
সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর চীন থেকে ৩০ লাখ টাকার তুলার বদলে আসা কন্টেইনারভর্তি বালু উদ্ধার করেন কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা। তুলা আমদানির ঘোষণা দেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সৈয়দ ট্রেডার্স। কিন্তু ৯১৬ ব্যাগ (২০ টন) বালু আসায় চালানটি আটক করা হয়। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, বালুর নমুনা পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রতিবেদন আসার পর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে গত ৯ অক্টোবর চীন থেকে আসা একটি কন্টেইনার খুলে পাওয়া যায় বালু আর মাটিভর্তি বস্তা। ২৫ টন সুতা আমদানির ঘোষণা দেওয়া হলেও আসে এসব মূল্যহীন বালু মাটি। গাজীপুরের এনজেড এক্সেসরিজ লিমিটেডের নামে চালানটি বন্দরে আসে। চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল আগ্রাবাদের সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান কালকিনি কমার্শিয়াল এজেন্সিজ লিমিটেড।
গত বছর এমন তিনটি ঘটনা শনাক্ত হয়। এ তিন ঘটনায় পাচার হয়েছে প্রায় ৯৭ হাজার ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮১ লাখ টাকা। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর একটি কন্টেইনার খুলে ৪১০ বস্তা বালু আর মাটি পাওয়া যায়। অথচ তাতে ১৯ হাজার ৬০০ কেজি কাগজ থাকার কথা। এর আগে গত বছরের ১৯ মে কাস্টমস কর্মকর্তারা চীন থেকে আসা একটি কন্টেইনার খুলে তাতে কোন পণ্য পাননি। অথচ কন্টেইনারে ১১ হাজার ডলারের মাশরুম আনার কথা ছিল।
এছাড়া ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মূল্যহীন পণ্য এনে পুরো অর্থ পাচারের আরও আটটি ঘটনা শনাক্ত করেছে কাস্টমস। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বন্দরে ২২টি কন্টেইনার খুলে পাথর, সিমেন্ট ও বালু মিশ্রিত পাত উদ্ধার করা হয়। এসব কন্টেইনারে চীন থেকে আমদানি করা দুই লাখ ৩৬ হাজার ডলারের ৪৭৩ টন ইস্পাতের পাত থাকার কথা ছিল। ২২ কন্টেইনারে ইস্পাতের পাত পাওয়া গেছে ৬৬ টন। বাকি ৪০৭ টন পাথর, সিমেন্ট ও বালু মিশ্রিত নকল পাত। এ হিসাবে ৩৩ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। বাকি দুই লাখ তিন হাজার ডলারের পণ্যই আসেনি। এর আগে ৪৩ কন্টেইনার একটি চালানে এক হাজার টন সরিষা থাকার কথা থাকলেও পাওয়া যায় মাত্র দশমিক ২ টন। অথচ সরিষা আমদানি করতে সিঙ্গাপুরে সাড়ে ৩ কোটি টাকার সমান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো হয়।
শুল্কফাঁকি দিতে এক পণ্যের বদলে অন্য পণ্য আমদানির ঘটনা কমবেশি ঘটলেও একেবারে মূল্যহীন বালু-মাটি, ছাই ভর্তি কন্টেইনার আসার ঘটনা সবাইকে অবাক করছে। তবে এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না কাস্টম কর্তৃপক্ষ। আছে যথাযথ তদারকির অভাবও। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার বিল অব এন্ট্রি জমা দেয়া হয়। এ সকল বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে সঠিক পণ্য আমদানি হচ্ছে কিনা তা তদারকির দক্ষ জনবল সঙ্কট রয়েছে। একইসাথে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে অসাধু আমদানিকারকের যোগসাজশের অভিযোগও রয়েছে।
কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, তদন্তে অর্থ পাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরই মামলা হয়। তবে তদন্তে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। যথারীতি ব্যাংকিং চ্যানেলে ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে ঘোষিত পণ্যের বদলে অন্য পণ্য আসলে অনেক ক্ষেত্রে আমদানিকারক বিদেশী রফতানিকারককে দোষারোপ করে। অনেকে আটক পণ্য রফতানিকারকের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার আবেদন করেন। আবার অনেক সময় যে প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির নামে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা হয়েছে পণ্য আটকের পর তারা তা অস্বীকার করে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে আমদানিকারক ভুয়া ঠিকানা দিয়েছে। ফলে তাদের সনাক্ত করতে দেরি হচ্ছে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ