নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করণের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে গত মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের জন্য দেশের উপক‚লভাগের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার মূল প্রজননস্থলে সব ধরনের মাছসহ সারাদেশে ইলিশের আহরণ, পরিবহন ও বিপণন বন্ধ হয়ে গেছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে ১৯৯৫ সালে সংশোধিত ১৯৫০ সালের ‘ফিস প্রটেকশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন আইন’ অনুযায়ী সরকার এ লক্ষ্যে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। প্রজননকালে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকায় দেশে ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়বে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদফতর। আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে ৪ দিন, পূর্ণিমার দিন ও পরের ১৭ দিনসহ মোট ২২ দিন দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপক‚লীয় জলাশয়ে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে। এ লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পুরো কার্যক্রম মনিটরিং করা হবে। এ সময়কালে ইলিশ আহরণ বন্ধে জেলা-উপজেলা প্রশাসন ছাড়াও পুলিশ, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও নৌবাহিনী কঠোর নজরদারি চালাবে। তবে নিষিদ্ধ সময়ে ভারতীয় জেলেরা বঙ্গোপসাগরে আমাদের নৌসীমা থেকে যাতে ইলিশ লুটে নিতে না পারে সে বিষয়ে অধিকতর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সারাবিশ্বে উৎপাদন হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে গত দেড় দশকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত ও আহরিত হয়ে থাকে। আর গতবছর দেশে যে প্রায় সোয়া ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে তার ৬০%-ই পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগের অভ্যন্তরীণ ও উপক‚লীয় জলাশয় থেকে। গত দুই দশকে বরিশাল বিভাগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০% এরও বেশি।

বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে পরের এ সময়ে দেশের চট্টগ্রাম উপক‚লের মীরসরাইয়ের মায়ানী পয়েন্ট, ভোলার তজুমদ্দিনের পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্ট, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পয়েন্ট এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতা চাপলি পয়েন্টের ধলচর দ্বীপ, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ ও কালিরচর দ্বীপ এলাকায় মা ইলিশের অত্যাধিক প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়।
গতবছর প্রজননকালীন সময়ে প্রজনন ক্ষেত্রসমূহে নমুনা পরীক্ষা করে ৮৩% ইলিশ রেনুপোনা পাওয়া যায়। এ সময়ে অন্য মাছের রেনু পোনাও পাওয়া যায় ১৭%। ফলে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন ২২ দিনে উপক‚লে অন্য মাছেরও নিরাপদ প্রজনন স¤পন্ন হচ্ছে। যা দেশে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর।

ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখাসহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্র্যকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষে গত ২৬ জুন থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জালসহ অন্য ক্ষতিকর জাল দিয়ে যে পরিমাণ জাটকা আহরণ করা হয়, তার এক-দশমাংশ রক্ষা করা গেলেও বছরে আরো অন্তত ১ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেত।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, একটি পরিপক্ক ইলিশ প্রতিদিন স্রোতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে পারে। মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম থেকে ফুটে বের হবার পরে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারি ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে। এরা খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারি ক্ষেত্রসমূহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনের লক্ষে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্কতা অর্জন করে প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। এর পরে তারা আবার স্বাদু পানির নার্সারি ক্ষেত্রে ফিরে আসে।

সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা খাদ্য গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে সেগুলোকে মৎস্য বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ নার্সারি ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করায় অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। চাঁদপুরের ষাটনল থেকে ল²ীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ’ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে ভোলার চরইলিশা হয়ে চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর ১শ’ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ন পদ্মার ১২০ কিলোমিটার এবং বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জের লতা, নয়াভাঙনী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলের ৮২ কিলোমিটার এলাকায় নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করায় উৎপাদন আশাব্যাঞ্জকভাবে বাড়ছে। চলতি অর্থ বছরে এ মাছের উৎপাদন সাড়ে ৫ লাখ টনের কাছে পৌঁছাতে পারে বলে আশাবাদী মৎস্য বিজ্ঞানীরা।