পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/ এ জীবন মন সকলি দাও/ তার মত সুখ কোথাও কি আছে/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও’ (কামিনী রায়)। এই কবিতার মতোই যেন আমরা হয়ে গেছি। আমাদের রাজনীতিকরা, আমলারা নিজেদের চেয়ে পরের কথা বেশি ভাবেন, তাদের স্বার্থের প্রতি বেশি মনযোগী। দেশীদের বদলে পরদেশীদের কথা ভেবে মহিয়ান হতে চান। পরদেশীদের জন্য তাদের মানবিকতা যোগ হলেও দেশীদের ক্ষেত্রে সেটার বিয়োগ ঘটেছে। যার পরিণতি তিস্তা চুক্তি অধরা থাকলেও মানবিক কারণে ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরার সাবরুমে দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় চলছে তর্ক-বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ। ফেসবুক, বøগ, টুইটারে এমন সব শব্দের ব্যবহার হচ্ছে যা পত্রিকায় প্রকাশের মতো নয়।
বিবিসি খবর প্রকাশ করেছে ‘মানবিক কারণে ভারতকে ফেনী নদীর পানি দিল বাংলাদেশ’। প্রচার হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সাক্ষাৎকার। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ইস্যুতে আন্তর্জাতিক এই গণমাধ্যম বেশ কয়েকটি খবর প্রচার করেছে। ‘তিস্তা অধরাই তবু কেন ভারতকে ফেনী নদীর পানি দিল বাংলাদেশ’ ‘দুই বন্ধু দেশের সীমান্তে কেন কাঁটাতারের বেড়া’ ‘ফারাক্কা-যে ফর্মূলায় পানি ভাগাভাগি করে ভারত’ ‘শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে বাংলাদেশ কি পেল?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি প্রতিবেদন বিপুল সংখ্যক পাঠক পড়েছেন। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র দমোদর মোদীর বৈঠকে ৭ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই এবং ৩টি প্রকল্প উদ্বোধন নিয়ে নানান মন্তব্য, বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, বøগে। বিতর্ক বেশি তিস্তা চুক্তির কোনো অগ্রগতি না হওয়া এবং ‘মানবিক কারণে’ ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়া নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন আমাদের দেশের রাজনীতিক ও আমলারা বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে ভারতের জনগণের প্রতি ‘বেশি মানবিক’। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বছরের অধিকাংশ সময় নদীতে পানি থাকে না। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিশূন্য হয়ে পড়ে। মরুভূমি হওয়ার পথে শত শত মাইল এলাকা। সেদিকে ভ্রæক্ষেপ নেই। তিস্তা নদী পাড়ের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ দুর্দশা তাদের স্পর্শ করবে না। অথচ ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম অঞ্চলে মরুভূমি ঠেকাতে ফেনী নদীর পানি দেয়ার সমঝোতা হয়েছে।
আমি তিস্তা পাড়ের ছেলে। নদী পাড়েই হেসে খেলে বেড়ে উঠেছি। ছোটবেলায় দেখেছি তিস্তা উজান থেকে শুধু পানিই নয়, প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি নিয়ে আসে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সেচ কাজ, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, উদ্ভিদরাজিসহ পুরো ইকোলজিক্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে সেই পানি। তিস্তার পানির প্রবাহ বাংলাদেশের সেচ কাজ, মৃত্তিকার উর্বরতা, জীববৈচিত্রকে সতেজ রাখে। হাজার হাজার জেলের জীবিকার যোগান দিয়েছে তিস্তা নদী। তিস্তার পানি উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য জীবনমরণ সমস্যা। ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারেজ হওয়ার পর হাজার হাজার হেক্টর জমি তিস্তার পানি দিয়ে চাষাবাদ হয়। কিন্তু উজানে ভারতের অংশে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে অবৈধভাবে পানি প্রত্যাহার করায় ভাটিতে (বাংলাদেশে) তিস্তার পানি প্রবাহ কমে গেছে। ভারত পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার এলাকার গজলডোবায় তিস্তা নদীতে সেচ প্রকল্প ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশের লালমনিরহাটে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় পানির তীব্র সংকট এখন আন্তর্জাতিক খবর। পানি সংকটের কারণে নদীর নানান প্রজাতির মাছ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নদীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ছিল, তারাও প্রায় বিলুপ্ত। নদীতে পানি প্রবাহের অভাবে জীববৈচিত্রের এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী ভারতের অবৈধ ভাবে পানি প্রত্যাহার। তিস্তায় পর্যাপ্ত পনি না থাকায় মানবিক বিপর্যয়ে লাখ লাখ মানুষ।
তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতপর লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। তিস্তার দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে ১২৫ কিলোমিটার। লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার তিস্তা অববাহিকায় লাখ লাখ মানুষ মাছ ধরাসহ নানান পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন বছরের বেশির ভাগ সময় নদী শুষ্ক থাকায় কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে লাখ লাখ মানুষ। তিস্তা পাড়ের মাঝি-মাল্লারা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ পেশা বদল করেছেন; কেউ বা জীবিকার তাগিদে দেশান্তরি হয়েছেন। বছর দেড়েক আগে নিলফামারীর ডালিয়া ব্রীজের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জেলে মো. শহিদুলের সঙ্গে। তার খলইয়ে মাছ দেখতে চোখ দিতেই তিনি বলে উঠেন, ‘বাহে, ৪০ বছর থাকি মাছ ধরি, বাজারোর মাছ ব্যাঁচে সংসার চালাই; ছাওয়া-পোয়া নিয়া খাই। কয় বছর থাকি অবস্থা খুব খারাপ, নদী গেইচে শুকিয়া, নদীত বেশি পানি নাই, পানি না থাকলে মাছ কি থাকে? অল্প এ্যাকনা পানি আছে তাত মাছো পাওয়া যায় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল ফ্যালে অল্প কয়টা মাছ পাইচো, এইগ্যালা দিয়া সংসার চলে না, হাতোত পাইসা কড়িও নাই’। শুধু শহীদুল নয়, নদী পাড়ে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, সাংবাদিক পরিচয় জেনে তারা তিস্তা চুক্তি কতদূর জানতে চেয়েছেন। তিস্তা পাড়ের জেলেপল্লীর ওই গরীব মানুষগুলোর বক্তব্য ‘যদি তিস্তা চুক্তি হইতো, তাহলে হামাক কষ্ট থাকতো না। হামরা নিদারুণ কষ্টে আছি’।
তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। উত্তরাঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, জীববৈচিত্র গড়ে উঠেছে তিস্তা অববাহিকায়। বছরের বেশির ভাগ সময়ে নদীতে পানি না থাকায় উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ঘটার উপক্রম হয়েছে। সবার প্রত্যাশা তিস্তা চুক্তি হলে সারাবছর নদীতে পানির প্রবাহ থাকবে। প্রাণ পাবে জীববৈচিত্র। বাংলাদেশ-ভারত পানি চুক্তি নিয়ে গত এক যুগে অনেক পানি ঘোলা হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দু’দেশের বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর; অতঃপর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে এক নম্বর এজেন্ডা ছিল তিস্তা চুক্তি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময়ও তিস্তা চুক্তি ইস্যু ছিল সর্বাগ্রে। বাংলাদেশের ট্রানজিট, করিডোর, সমুদ্রবন্দর সবকিছু ভারত নিলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অজুহাতে তিস্তা চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
পত্রিকার খবর মতে গত ১০ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, অনুচুক্তি, সমঝোতা স্বারক সই হয়েছে প্রায় শতাধিক। এতো চুক্তি এবং সমঝোতার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো তিস্তা চুক্তি। সেটা অধরাই থেকে গেল। অথচ উল্টো ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিতে সমঝোতা করা হয়। দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাবরুম শহরে সরবরাহ করা হবে, যাতে সেখানে পানির প্রয়োজনিয়তা মেটানো যায়। ফেনী নদীর পানি দেয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ মানবিক কারণেই ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ ত্রিপুরার ওই অঞ্চলটাতে খাবার পানি নেই। আর সে কারণেই কিন্তু পানি দিয়েছি। আমরা যদি পানি না-দিতাম, তাহলে কি কারবালার মতো হয়ে যেত না?’
কমিনী রায়েই কবিতার শেষ অংশ এমন ‘পরের কারণে মরণেও সুখ/ ‘সুখ-সুখ’ করি কেঁদো না আর/ যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে/ ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার/ আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। কবির ভাষায় ‘সুখ-সুখ’ করি কাঁদার মতোই আমরা ‘তিস্তার চুক্তি, তিস্তা চুক্তি’ করে কাঁদছি কেন? তিস্তার জন্য বেশি কাঁদলে তো হৃদয় ভার হবে। নিজের জন্য আমাদের আমরা-কূটনীতিকগণ নয়, তারা পরদেশীদের জন্যই। যে কারণে তাদের মধ্যে মানবিকতা যোগ-বিয়োগ হয়ে গেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।