Inqilab Logo

বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

‘জীবন দিয়ালামু হেনী নদীর হানি ভারতেরে দিতাম ন’

হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্র্য

মো.ওমর ফারুক ও মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন ফেনী থেকে | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

মানবিকতার কারণ দেখিয়ে ফেনি নদীর পানি ভারতকে দেয়ার সমঝোতা সই করেছে বাংলাদেশ। স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত। এই পানি তারা ত্রিপুরা সাব্রুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে। এ খবর প্রচার হওয়ায় ফেনী নদী পাড়ের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। তারা ভারততে পানি দেয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ফেনি নদী পাড়ের মানুষের মুখে এক আওয়াজ ‘জীবন দিয়ালামু, হেনী নদীর হানি ভারতেরে দিতাম ন’।

ফেনী নদী বাংলাদেশের সম্পদ। এর উৎপত্তি, প্রবাহ এবং ভৌগলিক অবস্থান নিশ্চিত করে ফেনী নদী কোনভাবেই আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহের সীমা রেখায় প্রবাহিত নয়। দেশি-বিদেশি যারাই ফেনী নদীকে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করছেন বহু বছর ধরে, তারা কখনই মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেননি। ভারত নিজেদের উত্তর-পূর্ব অংশের বেশ কটি রাজ্যের পানির অভাব মেটাতে দীর্ঘ বছর ধরে নানা কৌশলে ফেনী নদীকে আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক পাশে পার্বত্য রামগড় ও চট্টগ্রামের মিরসরাই, আরেক পাশে ফেনীর ছাগলনাইয়া। মাঝে কল কল ধ্বনিতে ধেয়ে চলছে ছাগলনাইয়ার গর্ব ফেনী নদী।
খাগড়াছড়ির পার্বত্য মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ির মধ্যবর্তী ভগবান টিলা থেকে ছড়া নেমে আসে ভাটির দিকে। আর আসালং-তাইন্দং দ্বীপ থেকে রূপ নেয় ফেনী নদী নামে। ভগবানটিলার পর আসালং তাইন্দং এসে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত ছড়াকে কেটে ভারতের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়েছে। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে বাংলাদেশের আমলীঘাট সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে ছড়া নেমে এসে ইজেরা গ্রামের সীমান্ত ছুঁয়ে বা ঘেঁষে ফেনী নদী নামে ভাটির দিকে ধেয়ে গেছে। প্রকৃত অর্থে এই তথ্যটি সর্ম্পূণ মিথ্যা ও বানোয়াট। কারণ ইজেরা গ্রামের সাথে আসালং-তাইন্দং এ বাংলাদেশের প্রায় ১৭শ’ একর জায়গার সম্পর্ক রয়েছে। যা ভারত গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে। আসালং তাইন্দং থেকে নেমে আসা ছড়া আমলীঘাটের এখানটাতেই ছাগলনাইয়া ছুঁয়ে ফেনী নদী নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলেছে।

দেশ বিভাগের আগে ১৯৩৪ সালে ভারত, ফেনী নদীর পানি নেয়ার দাবি ওঠায় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করলেও মূলত ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পযর্ন্ত নানা কৌশলে নো ম্যানস ল্যান্ড ও ট্রান্সবাউন্ডারির অজুহাতে আর্ন্তজাতিক নদী প্রবাহের অংশ দেখানোর চেষ্টা করে তারা।

প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে শুষ্ক মৌসুমে নদী তীরবর্তী চট্টগ্রামের মিরসরাই, খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা, ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজী, মুহুরী সেচ প্রকল্প, ফুলগাজী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণাংশ এবং নোয়াখালী-লক্ষীপুরের কিছু অংশের বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে পানির জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এতে করে লাখ লাখ হেক্টর জমি চাষাবাদের অনাবাদি হয়ে পড়বে। অকার্যকর হয়ে পড়বে ১৯৮৪ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের হাত ধরে তৎকালীন ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘মুহুরী’। যার আওতায় এ অঞ্চলের প্রায় ১৪ থেকে ১৫টি উপজেলার ৮/৯ লাখ হেক্টর জমিতে লোনামুক্ত পানির সরবরাহ করা হয়। যার মাধ্যমে শুধুমাত্র ফেনীর ৬টি উপজেলায় বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৮৬ হাজার মেট্টিকটন ফসল উৎপাদন হয়। এ প্রকল্পের আওতায় যেখানে ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস পাহালিয়া এ তিনটি নদীর পানি দিয়ে ৮/৯ লাখ হেক্টর জমির সেচকাজ করার কথা, সেখানে এখনই শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেয়া সম্ভব হয় না। মুহুরী সেচ প্রকল্পের প্রায় ৮০ ভাগ পানির মূল উৎস ফেনী নদী। ফেনী থেকে ২৫ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-ফেনী জেলার সীমানায় মুহুরী সেচ প্রকল্পটির অবস্থান। এখানে গড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত চিংড়ি ঘেরগুলো ধংস হবে। মুহুরী, সিলোনিয়া, পিলাকসহ প্রায় শতাধিক ছোট-বড় নদী, খাল ও ছরায় পানি শূন্যতা দেখা দেবে।

এক দশক আগ থেকেই ছাগলনাইয়া উপজেলার যশপুর খাল, ছাগলনাইয়া ছড়া, ফুলছড়ি খাল, হিছাছড়া, মন্দিয়া খাল, জংগলমিয়া খাল, পান্নাঘাট খালসহ অসংখ্য খালের তলা শুকনো মওসুমে পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এছাড়া মুহুরী প্রকল্পের নয়নাভিরাম পর্যটন সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে নিমিষেই। হুমিকর মুখে পড়বে কয়েক লাখ হেক্টর জমির গাছপালা। ফেনী নদী, মুহুরী ও কালিদাশ পাহাড়িয়া নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মৎস্য খামার বন্ধ হয়ে যাবে। যা থেকে উৎপাদিত মাছ দিয়ে পুরো চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ মৎস্য চাহিদা পুরণ করা যায়। বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদন হয় এ প্রকল্পের পানি দিয়ে। নদীর তীরবর্তী ২০-২২ হাজার জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকা অন্ধকারের মুখে পড়বে। বিলীন হয়ে যাবে বিরল প্রজাতির মাছ ও পশু-পাখি। সামুদ্রিক লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ধংস হবে সবুজ বনায়ন। দেখা দেবে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতা। বেকার হয়ে যাবে লক্ষাধিক কর্মজীবী মানুষ। পথে বসবে প্রায় ২০ লাখ পরিবার। সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ। ফেনী নদীর বালু মহাল ইজারার মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়ায় এ নদীতে পানি সঙ্কটের কারণে বালি উত্তোলন প্রক্রিয়াও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। হুমকির মুখে পড়বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার হাজার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

এদিকে দলমত নির্বিশেষে ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও সোনাগজীসহ ফেনীর মানুষ ফুঁসে উঠছে। ফেনী নদীর পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর ছাগলনাইয়ার মানুষের মধ্যে বেড়েছে উৎকন্ঠা। পানি আগ্রাসনে ফেনী নদী শুকিয়ে যাওয়ার এবং মুহুরী সেচ প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার আতঙ্কে রয়েছে নদীর তীরবর্তী ছাগলনাইয়ার জনগণ। ফেনী নদীর পানি রক্ষা আন্দোলনে সর্বশেষ ২০১২ সালের ৫ মার্চ লংমার্চ করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাতেও বরফ গলেনি ভারতের তাই ছাগলনাইয়াসহ ফেনীর মানুষের বক্তব্য একটাই ‘জীবন দিয়ালামু, হেনী নদীর হানি ভারতেরে দিতাম ন’।

গণদলের চেয়ারম্যান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা, ফেনী নদীর পানি রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারী নেতা এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ফেনী নদী একমাত্র নদী এ নদী বাংলাদেশের নদী। ৫৪টি অভিন্ন নদী ভারতের সাথে ১৯৭৫ সালে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। সে ৫৪ নদীর মধ্যে ফেনী নদীর নাম উল্লেখ ছিলনা। কিন্তু এ নদীর পানি ভারতকে দিয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রতি আঘাত হেনেছে। জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে আমাদের সরকার। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ফেনীসহ অত্র অঞ্চলকে মরণকরণের দিকে দাবিত করছে। এ চুক্তি অবিলম্ভে বাতিল করে জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

চট্টগ্রামের মিরসরাই পানি সম্পদ উন্নয়ন ফোরামের আহবায়ক ডা. মো. জামশেদ আলম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ফেনী নদীর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত বিপর্যয়কর। গত ৫/৭ বছর ধরে ভারতীয়রা অবৈধভাবে পানি তুলে নিয়ে যায়। চুক্তির মাধ্যমে পানি নিয়ে গেলে তাহলে এ নদীতে আর পানি থাকবে না। এতে করে মুহুরী সেচ প্রকল্পে মারাত্মক ভাবে বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। আমরা মনে করি ফেনী নদীর মালিকানা বাংলাদেশের। চুক্তি আগেও বাংলাদেশ ফেনী নদীকে ব্যবহার করতে পারে নাই। চুক্তির ফলে আমাদের আশঙ্কা নদীর মালিকানা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়দের হাতে চলে যাবে।



 

Show all comments
  • Tanweir Elahee ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 0
    No way govt already signed the deal this water will go to India
    Total Reply(0) Reply
  • Bonna Siddiqui ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 0
    খুবই ভালো সংবাদ।এই দেশের জনগণ এই দেশের মালিক,জনগণকে বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি আর মেনে নেয়া হবেনা।জাগো দেশবাসী জাগো
    Total Reply(0) Reply
  • উদাসী কাব্য ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 0
    বাজ্ঞালীর বিরোধিতা ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ
    Total Reply(0) Reply
  • Mojib Khan ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৬ এএম says : 0
    আসলে আমরা বাঙালি জাতি এমন এক জাতি। যা শুধু গোলামী করতে জানি, আমাদেরকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • RajOn Sami ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৭ এএম says : 0
    ফেনী নদীর পানি যেহেতু ভারত কে দেওয়া হয়েছে, তাই ফেনীর পাব্লিক গুলোর উচিৎ পানিতে টয়লেটের রাস্তা খুলে সোজা নদীতে ছেড়ে দেওয়া যাতে করে মনের সব কষ্ট দুঃখ পানির সাথ মিশে যায়। কারন এর থেকে বড়কিছু তো আর আমরা করতে পারবোনা।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Jamal Uddin ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশের মত এমন নতজানু সরকার বিশ্বে আর একটা আছে বলে আমার মনে হয়না
    Total Reply(0) Reply
  • Afnan Alam ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৭ এএম says : 1
    বাংলাদেশের মানুষ তাকিয়ে ছিল তিস্তা চুক্তি, সীমান্তে মানুষ হত্যা, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ভারতের জোরালো ভূমিকা এবং এনআরসি নিয়ে একটি ভাল খবরের। কিন্তু কোনটাই পূরণ হলো না। অত্যন্ত হতাশাজনক খবর বাংলাদেশের জন্য। ভারতের সেই চিরচেনা রূপটাই দেখা গেল। তারা শুধু নিতে পারে, দিতে পারে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Sufian Ahmed ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৮ এএম says : 0
    "ফেনী নদীর পানি কমে গেলে এই উপনদীগুলোতেও পানি প্রবাহ কমে যাবে। যার কারণে ফেনী নদীর সাথে সাথে হুমকির মুখে পড়বে এসব নদীর জীব-বৈচিত্র্য এবং এর স্থানীয় বাসিন্দারাও।," তিনি বলেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Saifuddin Islam Saif ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৯ এএম says : 0
    আপাতত এসব নিয়ে চিন্তার কোন কাজ নেই, তবে বিভিন্নরকম চাকরির পরিক্ষায় সাম্প্রতিক জ্ঞানের প্রশ্ন আসতে পারে। এটাই আমাদের লাভ
    Total Reply(0) Reply
  • Arif Khan ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১:১৯ এএম says : 1
    চট্টগ্রাম বন্দর ভারত'কে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। এতে দেশীয় অামাদানি-রপ্তানি ব্যাহত হবে। বরং মোংলা বন্দর ব্যবহার দেওয়া যেতে পারে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ