Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কি তিস্তার জট খুলবে?

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে গতকাল বিবিসি বাংলা দু’টি রিপোর্ট প্রকাশ করে। আবুল কালাম আজাদের লেখা ‘ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী’ এবং শুভজ্যোতি ঘোষের লেখা ‘প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে কি তিস্তার জট খুলবে?’ শীর্ষক প্রতিবেদন দু’টি ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী : ২০১২ সালের পর থেকে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে ভারতে ইলিশের অপ্রাপ্তির কথা তুলেছিলেন।

প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘পানি আসলে মাছও যাবে।’ প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকার পর শারদীয় শুভেচ্ছা হিসেবে এ বছর ভারতে পাঁচশ’ টন ইলিশ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রত্যাশিত তিস্তার পানি আসেনি। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তিটি কবে সেটাও অনিশ্চিত।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে ভারতে রয়েছেন। এই সফরকালে তিনটি ইস্যু বাংলাদেশে নানাভাবে আলোচনায় আছে : ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম শতক ছুঁয়েছে, বিশেষ আদেশে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে আর ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেয়ায় আকস্মিক বন্যার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকার কাঁচাবাজারে ইলিশ আর পেঁয়াজের দরদাম করতে গিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কথাবার্তায় শোনা গেল এসব ইস্যু। মাছ-বাজারে বিক্রেতা যেমন বলছেন, বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি না করলে দেশে দাম হয়তো আরেকটু কমতো। অপরদিকে ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে বলেই বাংলাদেশে এই লাগামহীন পেঁয়াজের দর।

ভারতের কিছু পণ্য ছাড়া বাংলাদেশের চলে না, সেটা যেমন অনেকে বোঝেন আবার দরকষাকষিতে ভারতকে ছাড়া দেয়া হচ্ছে এরকম ভাবনাও আছে জনমনে।

পেঁয়াজ-বাজারে এক ক্রেতা ক্ষোভ জানিয়ে বলছিলেন, ইন্ডিয়ার পূজা হচ্ছে। এখানে পূজা হচ্ছে না? ৫শ’ টন ইলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে, পেঁয়াজ বন্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে তিস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, ফারাক্কা বৃষ্টির দিনে খুলে দেবে, যখন দরকার তখন বন্ধ করে দেবে এটাই তো হচ্ছে নেগোসিয়েশন!
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় রয়েছে তার ওপরে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের মাত্রায় ভিন্নতা দেখা যায়।

অনেকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের পর পর দু’টি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে জেতার পর ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে তুলনাবিহীন কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, দু’টি নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক যে কোনো চাপ সৃষ্টির বিপরীতে ভারতের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে। এর ফলে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে উপকৃত হয়েছে, টানা ক্ষমতায় টিকে আছে কিন্তু দেশের স্বার্থে দরকষাকষিতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
তিস্তার জট খুলবে কি : তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো গত বৃহস্পতিবার থেকে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত গেছেন।

আড়াই বছর বাদে তাঁর এই দিল্লি সফরে তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে কোনো অগ্রগতি হয় কি না সে দিকে অনেকেরই সাগ্রহ নজর থাকছে।

ভারত ও বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন, তিস্তা নিয়ে আলাদাভাবে এখনই কোনো চুক্তি না-হলেও ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন তথা বেসিন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনে হয়তো এই সমঝোতাই তিস্তা চুক্তির ভিত গড়ে দিতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ ঠিক কতটা অনুকূল?
দিল্লিতে ও সেই সঙ্গে তিস্তা অববাহিকায় সরেজমিনে গিয়ে তা নিয়েই খোঁজখবর করেছিলাম নানা মহলে।
সিকিমের পাওহুনরি হিমবাহে উৎপত্তির পর প্রায় দুইশ’ মাইল পথ বেয়ে তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে বাংলাদেশের ভেতর।

এই নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহু বছরের যে জটিলতা, তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে স¤প্রতি কিন্তু দিল্লিতে বেশ তৎপরতা চোখে পড়েছে।
বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বাংলাদেশের একটা বহুদিনের দাবি ছিল ৫৪টা অভিন্ন নদী নিয়েই একটা সর্বাত্মক চুক্তি করা হোক। আমার ধারণা, এবার সে ব্যাপারে ভারত নীতিগতভাবে রাজি হয়ে যাবে।

যাতে কি না ওই সব নদীগুলোকে কভার করে সেগুলোর বেসিন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একটা সমঝোতা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, আলাদা করে প্রতিটা নদী নিয়ে হয়তো এখনই কিছু হবে না, তবে তিস্তাসহ সবগুলো নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এমন একটা ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো কিন্তু হতে পারে বলেই আমরা শুনতে পাচ্ছি।

এদিকে কিছুদিন আগেই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মধ্যে একান্ত বৈঠক হয়েছে। আড়াাই বছর বাদে এই প্রথম দু’জনের মুখোমুখি দেখা হলো, আর সেখানে তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জি সুর কিছুটা নরম করেছেন বলেই ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে। পাশাপাশি ভারতে তিস্তার আর একটি স্টেকহোল্ডার রাজ্য সিকিমের নতুন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও স¤প্রতি বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মেয়াজ্জেম আলী। হাইকমিশনার সৈয়দ মেয়াজ্জেম আলী বলেন, অগাস্ট মাসেই ভারতের জলসম্পদ সচিব ঢাকায় গিয়েছিলেন। তখনই কিন্তু আমরা আলোচনা করেছি, শুধু তিস্তা নয়, ৫৪টা নদীকে নিয়েই আসলে আমাদের এখন কিছু একটা করা দরকার। এই সবগুলো নদীতেই পলিমাটি জমেছে, নাব্যতা কমছে পাশাপাশি বন্যা আর খরা দুই রকম সমস্যাতেই আমাদের ভুগতে হচ্ছে। ফলে আমরা এখন এই নদী অববাহিকাগুলোর যৌথ ব্যবস্থাপনার ভাবনা নিয়েই এগোতে চাচ্ছি। তিনি বলেন, খরার মাসগুলোতে তিস্তার পানি আমরা কিভাবে ভাগাভাগি করতে পারি, সেটা সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই একটা অংশ। তবে ভারত যদি আজকের তারিখে তিস্তা নিয়ে আলাদা চুক্তি করতে রাজি থাকে, বাংলাদেশ তার জন্য বহু বছর ধরেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।

ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ বিশ্লেষক জয়িতা ভট্টাচার্য আবার বলেন, আসলে তিস্তার মতো একটা সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কোনো ইউফোরিয়া বা আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হোক, এটা ভারত বা বাংলাদেশ কেউই চায় না। কিন্তু তিস্তা নিয়ে হাইপ এড়িয়ে যেতে চাইলেও পানিসম্পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু অ্যাড্রেস করার ব্যাপারে দুইপক্ষই যত্মবান। কাজেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশাবাদী হওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে।
জয়িতা ভট্টাচার্য বলেন, এমন কী গত মাসেই ঢাকা সফরে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও বলে এসেছেন তিস্তাার ইস্যুটা তারা দেখছেন।

এতদিন তিস্তা চুক্তির বিপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যুক্তি দিয়ে এসেছে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানিই নেই- তাই ভাগাভাগি করেও লাভ নেই। আর বাংলাদেশের বক্তব্য ছিল, পানি যতটুকুই থাকুক- তার আধাআধি ভাগ করতে অসুবিধা কোথায়?

তিস্তাপাড়ের মিলনপল্লী গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণপদ মন্ডল যেমন বলেন, আগে বর্ষার সময়ে তিস্তার যে গর্জন শুনেছি, সেই বিকট আওয়াজে বাড়িতে ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম! আর আজ তো তার ছিটেফোঁটাও নেই। ড্যাম দিয়ে, নদী ভরাট করে তিস্তাটাকেই শুকিয়ে ফেলেছে। আগে তিস্তাপাড়ের লোক বলতে নিজের গর্ব হতো। আর এখন তো এটা একটা মরা খালের চেয়ে বেশি কিছু নয়!

শিলিগুড়িতে সেন্টার ফর হিমালয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক মৈত্রেয়ী চৌধুরী দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, পাহাড়ের দিকে এগোলে তিস্তাবাজার নামে একটা জায়গা পড়ে, তার একটু ওপরেই একটা ড্যাম তৈরি হয়েছে। তাতে কী হয়েছে, তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহটাই সেখানে শুকিয়ে গেছে। পানিটা ওখানে একেবারে স্থির! অনেকে ওখানে গিয়ে আমাকে তো জিজ্ঞেস করে, এটা কি একটা লেক না কি? আসলে তিস্তা এত প্রাণবন্ত ও উচ্ছ¡ল একটা নদী ছিল, নদীর পাশ দিয়ে চলার সময় যে কলতানটা শুনতে পেতাম সেই লাইফলাইনটাই যেন শুকিয়ে গেছে। তবে তা সত্তে¡ও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি ভাগাভাগিতে কিন্তু কোনো আপত্তি নেই পশ্চিমবঙ্গের এই প্রজন্মের যুবকদের।

জলপাইগুড়ির গাজলডোবাতে তিস্তা ব্যারাজের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুকান্ত সেন বলেন, আমাদের যেমন পানির প্রয়োজন আছে, তেমনি ওদেরও (বাংলাদেশ) তো প্রয়োজন আছে। সেখানে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বসে একটা ফর্মুলা ঠিক করে নিলেই তো হয়। পনি তো প্রকৃতির দান। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান সুবীর সরকার বলছিলেন, এই ডিফরেস্টেশেনের কারণেই বৃষ্টির পানি মাটি সঞ্চয় করতে পারছে না। কারণ স্লোপ বা ঢালটাই তো ফাঁকা হয়ে গেছে, ওখানে কোনও গাছপালাই নেই। তাই বৃষ্টি হলেই গোটা পানিটা তিস্তায় নেমে আসছে আর বর্ষাকালে বন্যা বা বন্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গোটা পানিটাই বয়ে চলে যাচ্ছে। হাইড্রোলজির বিশেষজ্ঞ ড. সরকার বলেন, ফলে যে কন্টিনিউয়াস ফ্লো শুকনো মৌসুমে বা লিন সিজনেও নদীকে সতেজ রাখে, সেটা কিন্তু একেবারেই শুকিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারত ও বাংলাদেশ যদি সত্যিই এবারে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারে, তা ঢাকার জন্য একটা ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে তিস্তার প্রবাহ নিয়ে ভারতীয় রাজ্যগুলো তাদের মর্জিমাফিক কিছু করতে পারবে না, একটা আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্ক তাদের মেনে চলতে হবে। তিস্তার ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য ভরসার কথা সেখানেই।



 

Show all comments
  • ahammad ৫ অক্টোবর, ২০১৯, ৩:০৬ এএম says : 0
    কথায় বলে ছাগলের বাচছা তিনটা হলে দুইটা ধুদ খায় একটা খুচিতে নাচে। বাংলা অবস্হা তিন নং বাচছার মতই, গদিটা ঠিক রাখলেই চলবে,যাহাই চান সবই দিয়ে দিব.........।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধানমন্ত্রী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ