Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজপথের কর্মসূচি চান তৃণমূলের নেতারা

আইনি লড়াই, সভা-সমাবেশে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন না

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না বলে স্বীকার করেছেন দলটির আইনজীবীরা। ১৯ মাস ধরে তার মুক্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন করে আসছে দলটির নেতাকর্মীরা। এসব কর্মসূচিতেও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পেরে হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এখন আর মানববন্ধন, সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি চান না তারা। এসব কর্মসূচিতে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় এবং তৃণমূলের নেতারাও। তাই রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি দেশের ৬টি বিভাগীয় শহরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মহাসমাবেশ করেছে বিএনপি। এসব সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নেতারা রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণার আহ্বান জানান। প্রয়োজনে রাজপথে রক্ত দিয়ে সেসব কর্মসূচি সফল করারও অঙ্গীকার করেন তারা।

শীর্ষ নেতাদের উদ্দেশ্যে স্থানীয় নেতারা বলেন, আমাদের নেত্রী (খালেদা জিয়া) কারাগারে, আমরা ভালো নেই। ঘরে ঘুমাতে পারি না। এই সরকারের অত্যাচার নির্যাতন এখন শরীরে সহ্য হয়ে গেছে। এখন মনে আর ভয় কাজ করে না। অতএব আর অপেক্ষা করবেন না কর্মসূচি দিন। নেত্রীকে মুক্ত করুন। দেশকে রক্ষা করুন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের বিভাগীয় সমাবেশে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, সিলেট সমাবেশে থেকে কর্মসূচি দিন। আমরা রাজপথে থাকবো। সিলেট বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দিলদার হোসেন সেলিম বলেন, রাতে তিন বার সমাবেশের মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছে, তিন বার এই সরকারের পুলিশ এসে ভেঙে দিয়েছে। আজকে মঞ্চ ছোট হবে না বড় হবে এটারো অনুমতি লাগে। এভাবে চলতে পারে না, সিনিয়র নেতাদের বলবো আপনারা কর্মসূচি দেন আমরা রাজপথে ছিলাম, আছি থাকবো।

সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন বলেন, সমাবেশের আগের রাতে ১৭ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। আরো হয়তো গ্রেফতার হবে। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কর্মসূচি কবে দেওয়া হবে? আমাদের নেতাকর্মীদের কে মুক্ত করবে।
হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গাউস বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে চেয়ে থাকি, আন্দোলনের কর্মসূচি আসে না। তাই আপনাদের বলতে চাই, বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। কুকুরের জন্য মুগুর প্রয়োজন। অতীতে হবিগঞ্জ জেলা আমাদের দখলে ছিল, কথা দিচ্ছি কর্মসূচি দিন এবারও রাখবো।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য খন্দকার আবদুল মুক্তাদির সিলেটের সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে ঢাকা সহ সারাদেশে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করার জন্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নেতাকর্মীরা নেত্রী মুক্তির চ‚ড়ান্ত ঘোষণা চান। বেগম জিয়ার মুক্তি ছাড়া তারা ঘরে ফিরতে চান না।

একইভাবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর বিভাগীয় সমাবেশের শুরুতেই স্থানীয় নেতারা তাদের বক্তব্যে বলেন, আজকে প্রধান অতিথি ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে বলবো- আমরা কোনও সমাবেশ চাই না, আমরা রাজপথে কর্মসূচি চাই। অবিলম্বে সেই কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমান অবৈধ সরকারের পতন ঘটিয়ে আমাদের নেত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনবো।

রাজশাহী মহানগর যুবদলের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সুইট বলেন, আমরা কর্মসূচি চাই। যে কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের মা’কে মুক্ত করতে পারবো, গণতন্ত্রের মা’কে মুক্ত করতে পারবো। শ্রমিক দল রাজশাহী জেলার সভাপতি রোকানুজ্জামান বলেন, আপনারা কর্মসূচি দিন। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই সরকারের পতন ঘটাব ইনশাআল্লাহ্। জয়পুরহাট জেলা বিএনপিসাধারণ সম্পাদক পলাশ বলেন, আমরা এই সরকারের কাছে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই না, আমরা সরকারকে মুক্তি দিতে বাধ্য করবো। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপিসাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা কোনও মানববন্ধন চাই না, লাগাতার আন্দোলন চাই।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ বিভাগীয় সমাবেশেও কতোয়ালী থানার বিএনপি সভাপতি হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জামালপুর জেলার সভাপতি শামীম তালুকদার, শেরপুর জেলার সভাপতি মাহবুবুল হক রুবেল শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানান। এর আগে গত ১৮ জুলাই বরিশালে, ২০ জুলাই চট্টগ্রামে ও ২৫ জুলাই খুলনার বিভাগীয় সমাবেশেও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনের পরিবর্তে রাজপথের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানান স্থানীয় নেতারা।

শুধু ঢাকার বাইরেও নয়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভায় শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য চলাকালীন সময়ে তাদের বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে কর্মসূচির দাবি জানান উপস্থিত নেতাকর্মীরা। ওই সভায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। কিন্তু দর্শক সারিতে থাকা কর্মী-সমর্থকরা বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা শুনতে আর রাজি নয় বলে চিৎকার করতে থাকেন। তারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে রাজপথের কর্মসূচি দেয়ার দাবি জানান। অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব বক্তব্য দেয়ার সময় দর্শক সারি থেকে কয়েকজন চিৎকার শুরু করেন, বক্তৃতা নয়, কর্মসূচি চাই, কর্মসূচি দিন। বিএনপি নেই, বিএনপি শেষ। বিএনপিকে বাঁচাতে হলে রাজপথের কর্মসূচি দিন বলে তারা বলতে থাকেন। এ সময় বিএনপির মহাসচিব কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, কর্মসূচি হবে, ধৈর্য ধরুন। কর্মসূচি চাইলেই তো হবে না, পালন করতে হবে। সব কিছুই হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। তার বক্তব্যের মধ্যেই কয়েকজন কর্মী চিৎকার করতে থাকেন ‘আমরা বক্তব্য শুনতে চাই না। কর্মসূচি দিন। মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই।

এর আগে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বক্তব্য’র সময়ও বিএনপির কর্মী সমর্থকরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। তারা বলেন, আমরা আর বক্তব্য শুনতে চাই না, কর্মসূচি চাই। কর্মসূচি দিন। এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা তার মুক্তি চাই। কিন্তু তার মুক্তি আইনি প্রক্রিয়ায় সম্ভবপর হবে বলে আমি মনে করি না। একমাত্র আন্দোলন ছাড়া বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব না। সেই জন্য সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। যাতে এবার আমরা পরাজিত না হই।

এদিকে গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, মানববন্ধন আর ছোটখাটো সভা-সমাবেশ করে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। এজন্য নেতাকর্মীদের আর মানববন্ধন নয়, এবার রাস্তায় নেমে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ফারুক বলেন, কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলুন। বেগম জিয়াকে মুক্ত করেই এবার ঘরে ফিরতে হবে।

বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকেই তার মুক্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ, প্রতীকী অনশন, লিফলেট বিতরণ, মানববন্ধনসহ নানান রকম কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। গত জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের ৬টি বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশ করেছে দলটি। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দলটির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন রাজধানীসহ সারাদেশে মানববন্ধন করেছে। এছাড়াও ঘরোয়া আলোচনা সভায় দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। যদিও খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া আইনজীবীরাও স্বীকার করেছেন আইনি লড়াইয়ে আর তাকে মুক্ত করা যাবে না।

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে সর্বত্র আওয়াজ উঠেছে। প্রতিটি মানুষ তার মুক্তি চায়। বহু দাগী ও ফাঁসির আসামি জামিন পেলেও খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিচ্ছে না। আমি বলি- খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে। তবে তার আগে শেখ হাসিনার পতন হবে। আন্দোলন সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, পৃথিবীতে যদি একদিন বাঁচতে হয়, সিংহের মতো একদিন বাঁচেন। কাপুরুষের মতো হাজার বছর বেঁচে লাভ নেই। আপনারা বার বার হাত তুলে বলছেন- ‘নেত্রীর মুক্তি চাই’, নেত্রীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করবেন? কিছু দিনের মধ্যেই আন্দোলন দৃশ্যমান। যখন আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, আমরা আশা করবো আপনারা সংগ্রামে নামবেন। তিনি নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, নেতারা যার যেখানে বাড়ি সেখানে কর্মীদের পাশে থেকে আন্দোলন করবেন। আমরা যদি প্রতিজ্ঞা করে রাস্তায় নামি তাহলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারবো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ