Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডাকঘরে ৭০ কোটি টাকার মচ্ছব

কাজে আসেনি ২০ হাজার পওস মেশিন

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

যেভাবে ‘রিসিভ’ করা হয়েছিল-সেভাবেই পড়ে আছে মেশিনগুলো। ভেতরে-কি আছে নিছক এ ধরণের কৌতুহল থেকে হয়তো খোলা হয়েছে দু’য়েকটি প্যাকেট। পরিদর্শনে গেলে যাতে দৃশ্যমান হয়-এমন চিন্তা থেকেও কোনো কোনো মেশিন সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলে। আক্ষরিক অর্থে কোনো কাজেই লাগেনি ডাক বিভাগের ‘পোস্টাল ক্যাশ কার্ড’ ক্যাশ-ইন-ক্যাশ আউট মেশিন-‘পয়েন্ট অব সেল’ (পিওএস)। রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা এবং বরিশালের কয়েকটি শাখা পোস্ট অফিস সরেজমিন পরিদর্শনে মিলেছে এ তথ্য। ডাক সচিব বলেছেন, আমার নীতি দুষ্টের দমন-শিষ্টের পালন। এরকম কিছু ঘটে থাকলে অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ডাক বিভাগ সূত্র জানায়, গ্রাহক সেবা আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সরকার ‘ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ প্রকল্প শুরু করে। প্রকল্পের ব্যয় ৫শ’ ৪০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ৫ হাজার ৫শ’ ৬টি ডাক ঘরকে ই-পোস্ট অফিসে রূপান্তর করা হয়। ই-পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বয়স্কভাতা প্রদানের কথা বলা হয়। ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’র প্রকল্পের সুবিধাটি নিতে হলে গ্রাহককে ৪৫ টাকা ব্যয়ে একটি আবেদনপত্র পূরণ করে ‘পোস্টাল ক্যাশ কার্ড’ কিনতে হয়। পরে আর কোনো খরচ নেই। তবে প্রতিটি লেনদেনের ৫ থেকে ১০ টাকা সেবা মাশুল নেয়া হয়। ই-ক্যাশ কার্ডে টাকা উত্তোলন এবং জমা দেয়া যায়। পোস্টাল ক্যাশকার্ডধারী গ্রাহকদের সেবা দিতে প্রয়োজন ‘পয়েন্ট অব সেল’ বা পিওএস (পওস)। এ যন্ত্রটি ডাক বিভাগের মূল সার্ভারের সঙ্গে সম্পর্কিত। পওস মেশিনের মাধ্যমে ক্যাশ কার্ড ক্যাশ ইন-ক্যাশ আউট হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২০ হাজার পিস পওস মেশিন কেনা হয় বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পওস মেশিনের খুচরা বাজার মূল্য ৬/৭ হাজার টাকা। কিন্তু ডাক বিভাগ প্রকল্পের আওতায় একেকটি মেশিন দরপত্রের মাধ্যমে ৩৫ হাজার টাকার বেশি দরে। অর্থাৎ, ৭০ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে পওস মেশিন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালে। কিন্তু এখনো পওস মেশিনগুলোর প্যাকেটই খোলা হয়নি। শাখা পোস্ট অফিসগুলোতে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে মেশিনগুলো। ধুলোবালিতে মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। পোস্ট অফিসগুলোতে সরবরাহের গত তিন বছরে একবারের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি এ পওস মেশিন।

ঢাকা জিপিওতে কর্মরত একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি জানান, ডাক বিভাগ অফিসিয়ালি দাবি করে আসছে যে, তাদের প্রবর্তিত পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত হয়েছে। ক্যাশ কার্ড থেকে আয়-রোজগারও শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ক্যাশ কার্ডের গ্রাহক দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। কিউ ক্যাশের এটিএম বুথে কিছু পোস্টাল কার্ড ব্যবহৃত হলেও পোস্ট অফিসে গ্রাহকরা আসেন না।

নানা জটিলতায় কেউ আর ক্যাশ কার্ড ব্যবহারই করছেন না। যাও দু’চার জন্য ক্যাশকার্ডের মাধ্যমে বয়স্কভাতা তুলতেন- তারাও এখন আর ডাক বিভাগ প্রবর্তিত ক্যাশ কার্ড ব্যবহার করছেন না। ক্যাশ কার্ডের অ্যাক্টিভ গ্রহিতা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তার দেয়া তথ্যের সত্যতা মিললো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত পোস্ট অফিসগুলো খোঁজ নিতেই।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শান্তিনগর পোস্ট অফিসে ক্যাশকার্ডে ক্যাশ-ইন করাতে যান আব্দুর রাজ্জাক। ওই পোস্ট অফিস ক্যাশ ইন করতে অপারগতা জানান। কুমিল্লার মেঘনা থানাধীন শিবনগর পোস্ট অফিসে ক্যাশ কার্ড নিয়ে ক্যাশ আউট করতে যান শফিউল আলম। পওস মেশিন সক্রিয় না থাকায় ব্যর্থ হয়ে তিনিও ফিরে আসেন। নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁও থানাধীন বারদী পোস্ট অফিসের কর্মচারীরা পোস্টাল ক্যাশকার্ড থেকে ‘ক্যাশ-আউট’ করার অনুরোধ পেয়ে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা জানান, এ রকম কোনো মেশিন তাদের কাছে নেই। বরিশাল রূপাতলী পোস্ট অফিসের পওস মেশিনটি প্যাকেট থেকেই খোলা হয়নি। ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেশের প্রায় সব পোস্ট অফিসের চিত্রই অভিন্ন।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কোনো গ্রাহক সেবা নয়- প্রকল্পের অর্থ লোপাট করার উদ্দেশ্যেই পোস্টাল কার্ড গ্রাহকের সুবিধার কথা বলে ২০ হাজার পওস মেশিন কেনা হয়। বাস্তবে কোনো শাখা পোস্ট অফিসেই পোস্টাল কার্ডের ২০ জন গ্রাহকও সক্রিয় নেই। অভিযোগ রয়েছে, ই-সেন্টারে পোস্টাল কার্ডের কোনো সেবাই দিতে পারছে না ডাক বিভাগ। সেবা প্রদানের নামে কোটি কোটি টাকার অর্থ লোপাট হয়েছে।

ই-সেন্টার প্রকল্পের পওস মেশিন নিছক একটি অপচয় প্রমাণিত হলেও ‘মেইল প্রসেসিং প্রজেক্ট’র আওতায় আরো ২৫ হাজার মেশিন কেনা হচ্ছে। এটিও মহাপরিচালকের কোটি কোটি টাকার কমিশন বাগিয়ে নেয়ার একটি ফাঁদ বলে জানায় সূত্রটি।

ডাক অধিদফতরের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র (প্রকল্প পরিচালক ও তৎকালিন অতিরিক্ত মহাপরিচালক-পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি এসব প্রকল্প করছেন বলে জানা গেছে। অর্থ পকেটস্থ করার লক্ষ্যেই তিনি একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন। অথচ গ্রাহক সেবার দিকে মন নেই তার। কথিত এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি পাতানো টেন্ডার করেন। গোপন সমঝোতায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে যন্ত্রপাতি কেনেন। হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।

ডাক বিভাগের সাবেক একজন মহাপরিচালক এটিকে ‘সরকারি অর্থের মচ্ছব’ বলে বর্ণনা করেছেন। অবসরে যাওয়া এ মহাপরিচালক বলেন, যেটির কোনো গ্রাহকই নেই সেটি কোনো ‘গ্রাহক সেবা’ হতে পারে না। এটি নিছক সরকারি অর্থ লুটপাট। এ লোপাটের গ্রহণযোগ্য তদন্ত হওয়া উচিৎ।

এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানার জন্য কথা বলতে গত ৪ মাসে তিনবার সুধাংশু শেখর ভদ্রের দপ্তরে যান এ কর্মকর্তা। কিন্তু প্রতিবারই তিনি আমিনুর রহমান নামক একজন কর্মচারী নেতাকে পাঠিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তবে এ বিষয়ে স্পষ্ট কথা বলেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস। গত ২৬ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) এ প্রতিবেদককে বলেন, এ বিষয়ে ডাক মহাপরিচালকই ভালো জবাব দিতে পারবেন। তিনি দেশে ফিরলে জানতে চাইবো-এরকম কিছু হয়েছে কি না। তিনি বলেন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন-এ কথা আমি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সব সেক্টরকে জানিয়ে দিয়েছি। যেমনটি উল্লেখ করলেন- এমন কিছু ঘটে থাকলে নিশ্চয়ই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ