পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বঙ্গোপসাগর কোলে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল। সৈকত ও উপকূলের তটরেখা ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। তার কাছেই এখানে-সেখানে সৃজন হচ্ছে ছোট ছোট চর-দ্বীপাঞ্চল। তটরেখা বরাবর উপকূলভাগে বাংলাদেশের ভূখ-ের প্রায় সমান জাগছে আরেক বাংলাদেশ। ‘অমুক সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১০ ভাগ ভূখ- সমুদ্রে তলিয়ে যাবে’ মর্মে বিদেশি বিশেষজ্ঞ থিউরি এবং এনজিওদের বুলি অসাড় প্রমাডুত হতে চলেছে। কেননা সামুদ্রিক জোয়ারের আঘাতে উপকূল-দ্বীপাঞ্চলে যতটা ভূমি ভাঙছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে ছোট ছোট চরে পলল ভূমি জেগে উঠছে। বাড়ছে দেশের আয়তন।
প্রকৃতির আপন নিয়মেই তা ঘটছে। এটি প্রমাণ ও উপলব্ধির জন্য ‘বিশেষজ্ঞ’ ব্রেইনের দরকার হয়না। বৃহত্তর নোয়াখালী উপকূলে গেল দুই থেকে চার দশকের মধ্যে জেগে ওঠা নিঝুম দ্বীপ, স্বর্ণদ্বীপ, ভাসানচর, ঢালচরসহ চরাঞ্চল আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। চরে চরে উর্বর পলিমাটি। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ, ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, পাখির কলতান, হাঁসের ঝাঁক, গরু-ছাগলের বাথান এমনকি চপল হরিণের দলে দলে বিচরণ নিত্যদিনের প্রাণবন্ত ছবি।
গবেষকদের ধারণা, দেশের চর ও দ্বীপাঞ্চলে উত্থিত নতুন পললভূমি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের দশ ভাগের এক ভাগ ছাড়িয়ে গেছে। পুরোপুরি জেগে উঠার অপেক্ষায় আছে আরও কয়েকগুণ বেশি। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, ফেনী এবং ভোলা জেলায় সৃজিত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার বর্গ কি.মি. চরের নয়া জমি। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার আয়তন প্রায় ৫০ হাজার বর্গ কি.মি.। ১৯টি জেলার ৪৮টি উপজেলা এর অন্তর্ভূক্ত। উপকূলীয় এলাকা দেশের আয়তনের ৩০ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার ২৮ ভাগ লোক এ অঞ্চলে বসবাস করছে। এ বিশাল এলাকায় ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীপ উপদ্বীপ। শত শত নদ-নদীর অববাহিকা ও উৎসস্থল থেকে বিধৌত পলিমাটি এবং জোয়ারের পানির সাথে বয়ে আসা পলি-বালি জমতে জমতে সৃষ্টি হচ্ছে চর ও দ্বীপমালা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার উপকূলের বিভিন্ন চর-দ্বীপাঞ্চলে ক্রমেই ছোট ছোট চর কিংবা ডুবোচর সৃজনের পালা চলছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপদ কুতুবদিয়া। এ দ্বীপের আশপাশে ধীরে ধীরে জাগছে ছোট ছোট ডুবোচর। সেই সাথে প্রাচীনতম বাতিঘরের ঠিকানা কুতুবদিয়ার মানুষের মাঝে আশাও জাগছে। সমুদ্র উপকূলের তলদেশে (অফশোর) তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদ, মৎস্য, লবণ, ঝিনুক-মুক্তা-কড়ি, কৃষি-খামার মিলিয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের ধারক কুতুবদিয়া। আগামীতে এলএনজি টার্মিনাল, সরাসরি জ¦ালানি তেল সরবরাহে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসএমপি) স্টেশন, সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক জোনসহ দেশি-বিদেশি ব্যাপক বিনিয়োগের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনাময় এ দ্বীপকে ঘিরে ডুবোচর জাগায় আশার আলো দেখছেন এলাকাবাসী।
কুতুবদিয়ার বিবর্তন পরিবর্তন সম্পর্কে গবেষণা করেন এলাকার অন্যতম কৃতিসন্তান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন। তিনি জানান, অন্তত দেড় হাজার বছর পূর্বে সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে উঠে কুতুবদিয়া। সমুদ্রতলে কঠিন শিলাপাথরের ওপর এর ভিত্তি ও গঠন। ফলে এ দ্বীপ বিলীন হওয়ার আশঙ্কা নেই। বরং শংখ (সাঙ্গু) ও মাতামুহুরী উভয় নদীর ¯্রােতধারার সাথে অবিরত আসছে ব্যাপক হারে পলিমাটি। সামুদ্রিক জোয়ারের সাথেও জমছে বালির স্তর।
অতীতে এই দুই নদীর তীব্র স্রোতের ধাক্কায় কুতুবদিয়ায় ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বর্তমানে নদীর খরস্রোত আর নেই। গতিপথে চর পড়েছে অসংখ্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাসমূহের বিশেষত বান্দরবানের সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে শংখ ও মাতামুহুরী নদী বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মোহনায় পলিমাটি। এরফলে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা এ দ্বীপের পূর্ব পাশে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের চকরিয়া-মহেশখালী বরাবর কুতুবদিয়া চ্যানেলে জমছে পলিমাটি।
তাছাড়া দ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে এবং বাঁশখালী-চকরিয়া-পেকুয়ার কাছেও পলিমাটি জমছে। সেসব স্থানে এখানে সেখানে ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। ভাটার সময় ডুবোচরগুলো জাগছে এবং দৃশ্যমান হচ্ছে। আবার জোয়ার হলে ডুবে যায়। গত কয়েক বছরব্যাপী এসব ডুবোচর বিলীন কিংবা হ্রাস হতে দেখা যাচ্ছে না। এলাকার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাটার সময় তারা সেখানে জাল সাফ করে। ছেলেপুলেরা খেলাধুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দ্বীপের ইতিহাসক্রম থেকে জানা যায়, প্রায় ৩ থেকে ৪শ’ বছর পূর্বে কুতুবদিয়া দ্বীপের আয়তন ছিল ১৫৬ বর্গ কিলোমিটার। অবিরাম ভাঙনের কারণে কালক্রমে দ্বীপটি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ১৮৮০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত কুতুবদিয়ার আয়তন ছিল ৯৪ বর্গ কি.মি., ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ৮২ কি.মি., ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ৭৬ কি.মি., ১৯৬০ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ৭২ কি.মি.। বর্তমানে প্রায় ৬০ কি.মি. ঠেকেছে। স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকার কারণেই বঙ্গোপসাগরের আঘাত বুকে টেনে নিচ্ছে এ দ্বীপ।
কুতুবদিয়ায় মানুষের পদচারণা শুরু হয় অষ্টম খ্রিস্টাব্দে আরব বডুকদের মাধ্যমে। পরে ১২শ’ খ্রিস্টাব্দে মগ দস্যুরা দ্বীপে ঘাঁটি বানায়। ১৩শ’ সালে আরব থেকে আগত পীর আউলিয়া হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দিন (রহ.) সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে এসে এ দ্বীপকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলেন। তার নামানুসারে হয় কুতুবুদ্দিনের ডিয়া বা দ্বীপ। প্রাচীনকালে দ্বীপের পশ্চিমাংশে উঁচু বালুকাময় পাহাড় গড়ে ওঠে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন বলেন, কুতুবদিয়ার আশপাশে ডুবোচর জাগাতে সহায়ক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। দ্বীপের চারপাশে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সবুজবেষ্টনি গড়ে তোলা, আঁড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি পদক্ষেপ প্রয়োজন। ঝাউ বনায়নসহ বেড়িবাঁধে করই, খেজুর, নারিকেল, ইপিল-ইপিল, বাঁশ গাছ লাগাতে হবে নিবিড়ভাবে। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের সুরক্ষার এ দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ডুঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে দেয়াল হিসেবে কাজ করছে। তাছাড়া প্রধান সমুদ্রবন্দর তথা দেশের প্রবেশদ্বার কুতুবদিয়া এবং তার ঐতিহাসিক বাতিঘর। ছোট্ট ভূখ- হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় ভৌগোলিক গুরুত্ব ধারণ করে এ দ্বীপ।
কুতুবদিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুপ্রভাত চাকমা বলেন, এ দ্বীপে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং ব্যাপক বনায়ন করা প্রয়োজন। বনায়নের নামে অতিউৎসাহীরা বেশিহারে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর কারণে ভূমি ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। অথচ লাগাতে হবে উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষার উপযোগী প্রচুর দেশজ গাছপালা।
এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কুতুবদিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, বাঁধের বাইরে ডুবোচর থাকলে থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে কোন তথ্য নেই। ডুবোচর জাগানোর সহায়ক পাউবো’র কোন প্রকল্পও নেই।
এক নম্বর ধুরং ইউপি চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, জাতীয় পর্যায়ে এ দ্বীপ সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে ২০০০ সাল থেকে ‘দশে মিলে করি কাজ’ এবং ‘কুতুবদিয়া বাঁচাও আন্দোলন’র উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত আছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী চেয়ারম্যান শাহরিয়ার বলেন, জনসাধারণকে নিয়ে ঝাউবীথি, বাইন বাগান সৃজন করেছি। ১৯৯২ সাল থেকে তিন টার্মে ১৬ বছর দায়িত্ব পালনকালে এক লাখের বেশি বৃক্ষরোপণ করি। কিন্তু বেড়িবাঁধ না থাকায় রোপিত ৩০ ভাগ চারা হয়তো টিকে আছে। বেশিরভাগ সামুদ্রিক জোয়ার ও দুর্যোগে বিরান হয়ে গেছে। তার বাবা মরহুম রফিক আহমদ চৌধুরী ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন।
কুতুবদিয়া রক্ষায় এবং নতুন ডুবোচর জাগাতে সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে উপকূলীয় মানউন্নয়ন ও কর্মসংস্থান জোট, কুতুবদিয়া সমিতি চট্টগ্রাম, গ্রীনবেল্টসহ বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের দাবি, কুতুবদিয়া সুরক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ, এ দ্বীপের পশ্চিমে ডুবোচরের ওপর ৩০ মিটার বেইজওয়াল ও টেট্টাপট নির্মাণের মাধ্যমে আয়তন সম্প্রসারণের পদক্ষেপ এবং প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ মেগাপ্রকল্পে কুতুবদিয়াকে অন্তর্ভূক্ত করা। বাঁধের জোড়াতালি মেরামত হলেও মজবুত বেড়িবাঁধ আজও হয়নি। পাউবো গত ২৫ বছরে বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংরক্ষণের নামে প্রায় ২ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। অথচ সঠিক পরিকল্পনা অনুসারে বেড়িবাঁধ নির্মিত না হওয়ায় কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার চক্র দুর্নীতির মাধ্যমে হরিলুট করেছে। এর কোন সুফল কুতুবদিয়াবাসী পাননি।
দ্বীপরাষ্ট্র নেদারল্যান্ডস ডুবোচর ও চর জাগিয়ে মূল ভূখ-ের সাথে যুক্ত করার ক্ষেত্রে বিশে^ সবচেয়ে সফল। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডসে তার সর্বশেষ সফরকালে এ বিষয়ে গভীর আগ্রহ দেখান। তিনি স্বচক্ষে তা অবলোকন করে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও মোহনায় ভূমি উদ্ধারে সেই কৌশল কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। নেদারল্যান্ডসের কৌশলটি হচ্ছে, প্রথমে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে উপকূলের পানি নিমগ্ন থাকা অংশকে ঘিরে ফেলা হয়। পরে পানি শূন্য হয়ে পড়লে জায়গাটি একটি নতুন সৃজিত জমি হিসেবে দেখা যায়। এর পাশাপাশি ক্রসড্যামের কারণে মোহনায় জমে পলিমাটি। তাও নতুন ভূখ-ের সৃষ্টি করে। নেদারল্যান্ডস পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভূখ- এ উপায়ে উদ্ধার এবং যোগ করেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।