পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হোসনে আরার লবণের মাঠ অধিগ্রহণে পড়ে গেছে। তার স্বামী আলম ঘুরছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ভবনের এলএ শাখার বারান্দায়। আট শতক জমির ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে এসেছেন। এরজন্য ৪৫ হাজার টাকা দালালের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। আরেক হাতে তিন লাখ টাকার চেক নেবেন। অর্থাৎ মোট পাওনা টাকার ১৫ শতাংশ ঘুষ গ্রহীতা ও দালাল খেয়ে ফেলছে।
মহেশখালীর আঁধারঘোনা কালামার ছড়ায় নির্মাণাধীন মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য হোসনে আরা ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এলএ শাখার বারান্দায় এবং কাছে-কিনারে মহেশখালীর লোকজনের ছোট ছোট জটলা দেখা গেল বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। বোঝা গেল দালালের সামনে দাঁড়িয়ে চলছে কথাবার্তা। জানলাম প্রায় প্রতিদিন এভাবে জমজমাট থাকে। তখনও দরজা খোলা দেখে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার অফিসে যাই। জানালেন, অনেক সময় নাকি আরও রাত পর্যন্ত কাজ চলে। জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতাও ‘কাজ’ নিয়ে বসে আছেন।
এলএ শাখার বারান্দায় এবং বাইরের চত্বরে আলম ছাড়াও মুখোমুখি হই আট-দশ জনের সাথে। সবার হাতে কাগজপত্র। নিজের পরিচয় দেই। ভূমির ক্ষতিপূরণের টাকা আটকে যেতে পারে- এই আশঙ্কায় পত্রিকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোলামেলা কথা বলেন তারা। একজন বলে ওঠেন, ‘কক্সবাজার কী ঘুষ-দালালির বাজার হয়ে গেল? অধিগ্রহণের টাকা দেব-দিচ্ছি বলে দালাল ঘুরাচ্ছে চরকার মতো। কষ্ট হয়রানির শেষ নাই’।
অন্যরা বললেন, দেশের স্বার্থে মহেশখালীতে উন্নয়নের মেগাপ্রকল্পের জন্য লবণমাঠ, চিংড়ি ঘের, নালজমি, কৃষিজমি, ভিটেমাটি পর্যন্ত চিরতরে ছেড়ে দিয়েছি। তার বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি? জমিজমার ন্যায্য মূল্যও বুঝে পাচ্ছি না। উল্টো দালালকে ঘুষ ও কমিশনের টাকা আগে গছিয়ে দিতে হচ্ছে। ঘুষের ভাগ নাকি কতিপয় জনপ্রতিনিধিসহ উপরের দিকে চলে যায়। দৈনিক কোটি টাকা হাতবদল।
ভূক্তভোগীরা অধিগ্রহণকৃত জমি ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে বরাদ্দ টাকার হিসাব দিতে গিয়ে জানান, ১২ থেকে ৩০ শতাংশ টাকায় থাবা দিচ্ছে ঘুষ-দালালের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। সরাসরি এলএ শাখার কর্মকর্তাদের হাত থেকে টাকা উত্তোলনের কোন উপায়ই নেই। সব ডকুমেন্ট প্রসেস করাতে হয় নির্দিষ্ট দালালদের মাধ্যমে। অন্যথায় দলিল ও কাগজপত্রে ‘গন্ডগোল’ ‘ভুল-ত্রুটি’ আছে বলে সোজা বিদায়। দালাল ধরলে সবই ঠিক। দালালের বাধ্যগত না থাকলেও জমির ‘ঘাপলা’ ‘বিরোধ’ আবিস্কার করা হয়। এমনকি আপত্তি মামলা টুকে দেয়া হয়। তখন ঘুষ ও দালালির রেইট লাফিয়ে উঠে ৩৫ থেকে ৪০ ভাগে। মোদ্দাকথায় কক্সবাজার এলএ শাখায় ঢোকার আগেই দালাল চক্রের কাছে পুরোদমে জিম্মি হতে হচ্ছে ভূমি মালিকদের।
স্থানীয় লোকজন বলেন, সরকার দলীয় কিছু নেতা, জনাকয়েক শিক্ষানবীশ উকিল, নামধারী সাংবাদিক, ঠিকাদার, এলাকার টাউট-টন্নি মিলে দালালচক্র গড়ে উঠেছে। এলএ শাখা থেকে মহেশখালী পর্যন্ত যার জাল বিস্তৃত। মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরজন্য বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। তা চলমান রয়েছে। একে ঘিরেই ঘুষ-দালালের হাট বসে গেছে। সেই টাকার ভাগ কতিপয় অসৎ ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানের পকেটে চলে যাচ্ছে। ভূমিঅধিগ্রহণের দালালি যেন ‘আলাদীনের চেরাগ’। দালাল চক্রে এমন লোকজন আছেন, আগে ছিলেন ঝুপড়ি ঘরের বাসিন্দা। আজ কোটিপতি।
প্রসঙ্গত কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ঘুষ-দুর্নীতি, হয়রানি, দালালচক্রের দাপটের অভিযোগ নতুন নয়। এসব কথা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে। ইতোপূর্বে ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণকালে কক্সবাজারের সাবেক ডিসি রুহুল আমিনসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। সাবেক জেলা প্রশাসক যান কারাগারে, এখন আছেন জামিনে।
সরেজমিনে জানা অভিযোগ
মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পস্থলে সরেজমিনে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলি। যেমন-হোয়ানক, হেতালিয়া, কালারমার ছড়া, হরিয়ার ছড়া, পানির ছরা, অমাবশ্যাখালী মৌজার ভূমির মালিক যারা অধিগ্রহণকালে জমি ছেড়ে দিয়েছেন। তারা ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে গণহারে হয়রানি, ঘুষ, অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন।
স্থানীয়রা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। অথচ আজো তেমন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। সরকারের সদিচ্ছার উল্টো পথেই হাঁটছেন মাঠ প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী। আগে তো লবণ, চিংড়ি, ধান, শাক-সবজি চাষ করে পরিবারগুলোর স্থায়ী একটা আয়-রোজগারের উপায় ছিল। চিরতরে ভিটেমাটি জমিহারা মানুষ এখন অসহায়। এসব নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়।
উত্তর মুহুরীঘোনা ধলঘাটার সাহাব উদ্দীনের পরিবারের এক একর ৮৪ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ কয়েত দফায় পেয়েছেন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এরমধ্যে দালালকে দিতে হয় ১২ শতাংশ। ওই এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, সমুদ্রবন্দর এবং বেজা’র উদ্যোগে অর্থনৈতিক জোন করা হচ্ছে। একই মৌজায় অহিদুল কবির জানান, তিনি দালালকে দেন ১২ ভাগ। ফরিদ দেন ১৩ ভাগ। বানিয়ার ডেইল ধলঘাটার আখতার বলেন, তার পরিবারের ৫ একর জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য নিজেরা কাগজপত্র প্রসেস করেন।
তা সত্তে¡ও এলএ শাখার লোকজনকে ঘুষ-বকশিশ বা স্পিডমানি (স্পিডে কাজ করার জন্য) দিতে হয়েছে পাওনা টাকার ৮ শতাংশ। মাতারবাড়ির আবদুল মালেকের পরিবারকে অধিগ্রহণের টাকা পেতে ৩০ ভাগ দালালের হাতে দিতে হয়েছে। মাতারবাড়ি বাজার, ধলঘাটে চায়ের দোকানে অনেকেরই ক্ষোভের সুরে কথাবার্তায় ছিল ভ‚মি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে গিয়ে ঘুষ-দালাল চক্রের যথেচ্ছ কমিশনবাজি, হয়রানি।
পন্ডিতের ডেইল ধলঘাটার শাহীন ২ একর জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ বাবদ চেক পেতে গিয়ে ঘুষ ও দালালির কমিশন দিয়েছেন ২১ ভাগ। আবার মামলা-মোকদ্দমার জালে আটকে গেছে অনেকেরই অধিগ্রহণের পাওনা। মেগা প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের টাকা লুটে নিতে দেদারসে বাণিজ্যও চালাচ্ছে দালালচক্র। বিভিন্ন স্থানে রাতারাতি বাড়িঘর, দোকানপাট, স্থাপনা বানিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
অন্যদিকে মাতারবাড়ির যুবক আজগর আলী বলেন, মৌজা রেইটে জমি ছেড়ে দিয়েও আমরা ঠকে গেছি। কারণ বর্তমান জমির প্রকৃত দামের চেয়ে ভূমি অধিগ্রহণের মৌজা রেইট অনেক কম। তার ওপর ঘুষ-দালালের ৩০ ভাগ পর্যন্ত সেয়ানা ট্যাক্স! আমরা কার কাছে বিচার চাইব? কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায় মহেশখালীর মেগাপ্রকল্পের ভ‚মিঅধিগ্রহণ বিষয়ে স্বীকার করা হয়েছে, “অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য মৌজা রেইট অবিশ্বাস্যভাবে কম”।
এদিকে মহেশখালীর প্রকল্পসমূহের বিষয়ে এবং ভ‚ক্তভোগীদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চাইলে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৪ টায় সাক্ষাতের সময় দেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। তবে কার্যালয়ে গেলে জানানো হয় তিনি বাইরে গেছেন। এরপর গতকাল পর্যন্ত একাধিকবার ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে কোনো সাড়া মিলেনি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, দুর্নীতি-হয়রানিমুক্ত সেবাদানে চেষ্টা করছি। শতভাগ স্বচ্ছ হয়তো বলা যায়না। জনগণ যাতে কোন দালাল বা মধ্যস্বত্ত্বভোগীর খপ্পরে না পড়ে সরাসরি এসে সেবাগ্রহণ করেন। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে নগদে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে বলেন, জমির বিষয়াদি অনেকে বোঝেন না। এজন্য ভ‚মিঅধিগ্রহণ ডকুমেন্ট প্রসেসে ভুলত্রুটি হতে পারে। সেবাগ্রহিতারা সরাসরি এলে তাও আমরা দেখি।
কঠোর ব্যবস্থা- ভূমিমন্ত্রী
মহেশখালীতে দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পসমূহের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি-অনিয়ম ও হয়রানি প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে গতকাল (বুধবার) ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে। শুধু ওখানে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের এলাকাগুলো থেকে এ ধরনের অভিযোগ শুনছি। বিশেষ করে ওই অঞ্চলে (মহেশখালী) ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব অভিযোগ রয়েছে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। হয়তো অনেক কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের জন্য মহেশখালীতে সাড়ে ১৩ হাজার একর ভ‚মি অধিগ্রহণ হয়েছে। আরও প্রায় তার অর্ধেক পরিমান জমি অধিগ্রহণ হতে পারে। হুকুম দখল, লিজ, বন্দোবস্তি দেয়া হয়েছে ১২ হাজার একরেরও বেশি। এরমধ্যে মাতারবাড়ি, কালামার ছড়া, সোনারপাড়া, হোয়ানক, ধলঘাট, শাপলাপুর, ইউনুছখালী, জাফুয়া, উত্তর নলবিলা ইত্যাদি এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি স্টেশন, জ্বালানি তেল সরবরাহে এসপিএম প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্রবন্দর, চার লেইন ও ছয় লেইন সড়কসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।