Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বগুড়ায় ভয়ঙ্কর কিশোর অপরাধ

বগুড়া ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বগুড়ায় কিশোর অপরাধের সবচেয়ে বড় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হল কিশোরী সেমন্তীর আত্মহনন। বগুড়া শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা জলেশ্বরীতলার বাসিন্দা হাসানুল মাশরেক রুমনের কিশোরী কন্যা সেমন্তী (১৬) স্থানীয় ওয়াইএমসিএ স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী। তাদের একটি পারিবারিক চিকিৎসা সংক্রান্ত ঘটনায় শহরের একটি ক্লিনিকে পরিচয় হয় ক’জন ধনী কিশোর ও তরুণের সাথে। পরিচয় সূত্রে বন্ধুত্ব ও পরে একজনের সাথে তা প্রেম পর্যন্ত গড়ায়। এক্ষেত্রে কিশোরী সেমন্তী প্রেমিককে বিশ্বাস করে তার কথামত প্রেমিকের কাছে নিজের কিছু একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়। আর এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
সেমন্তীর কাছে যেটা ছিল প্রেম ও বিশ্বাস। তার কিশোর প্রেমিকের কাছে সেটা ছিল স্রেফ ফান। এক অবুঝ কিশোরীর সেন্টিমেন্ট নিয়ে ছেলে খেলা! কিন্তু সেমন্তী যখন সেটা বুজতে পারে তখন পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। সেমন্তির প্রেমিক ও প্রেমিকের বন্ধুরা তার একান্ত মুহুর্তের ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ফলে প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গের কষ্ট, অভিমান ও ক্ষোভে নিজের ঘরে মধ্যরাতে গলায় ওড়নায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে।
গত জুন মাসে এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে সেমন্তীর বাবা হাসানুল মাশরেক রুমন তার নিজের ফেসবুক ওয়ালে মর্মবেদনার কথা লিখে মেয়েকে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেয়ায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন। সেমন্তীর এই অপমৃত্যু সাইবার কিশোর অপরাধী চক্রের নির্মম উদাহরণ মাত্র।
বগুড়ায় কিশোর অপরাধের আরও বহুবিধ ঘটনা রয়েছে। রয়েছে কিশোরী ধর্ষণের মত ভয়ঙ্কর ঘটনা। বগুড়ার সারিয়াকন্দি থানার একটি কেস হিস্ট্রিতে দেখা যায় এই উপজেলার পূর্ব টেংরাকুরা গ্রামের কিশোর বয়সী তিন বন্ধু আবদুর রহিম, আলী মিয়া ও রাসেল মিয়ার নজর পড়ে তাদেরই প্রতিবেশী এক কিশোরীর ওপর। ওই কিশোরীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়।
এরপর একদিন দুপুরে ওই কিশোরী যখন গ্রামের দোকান থেকে খাবার কিনে বাড়ি ফিরছিল তখন ক্ষিপ্ত তিন কিশোর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ চেপে পাশের একটি পাটক্ষেতে নিয়ে যায়। প্রেমে ব্যর্থ আবদুর রহিম তাকে ধর্ষণ করে। তবে অপরাধীরা কিশোর বয়সী হওয়ায় আদালতের নির্দেশে তাদের যশোরের পুলেরহাটে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
বেপরোয়া কিশোর অপরাধীরা কত তুচ্ছ ঘটনায় খুন পর্যন্ত করে পারে তার উদাহরণ এটি। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের নারিল্যা গ্রামের মতিউর রহমান মাস্টারের ছেলে নাজিউর রহমান নাহিদ (১৮) চলতি বছর বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে এক সহপাঠি ছাত্রীর প্রেমে পড়লে তার কিশোর বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়। তার প্রেমের প্রতিদ্বন্ধী ছিল তারই কিশোর বন্ধু রিয়াদ।
এর জের ধরে নাহিদ গত ১৯ এপ্রিল দুপুরে শাজাহানপুরের কমর উদ্দিন ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়ে মোটরসাইকেলে সহপাঠী বন্ধু জাহিদকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তখন অপর মোটরসাইকেলে আসা রিয়াদ ও তার অপর ৩ বন্ধু নাহিদকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। মামলার পর রিয়াদ, রবিউল, নীরব ও সুমন নামে ৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
একই ধাঁচের আরেকটি ঘটনার বিবরণে জানা যায়, জেলার গাবতলী উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের ব্যবসায়ী ইন্তেজার রহমানের ছেলে নাইম ইসলাম (১৮) একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে টেক্সটাইলের ছাত্র। যাতায়াতের সুবিধার্থে বাবা অ্যাপাচি মোটরসাইকেল কিনে দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মোটরসাইকেলটি হাতিয়ে নিতে তার বন্ধুরাই নাইমকে খুনের পরিকল্পনা করে। গত বছর ১৫ নভেম্বর পাশ্ববর্তী সারিয়াকান্দিতে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে কৌশলে নাইমকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। শুধু তাই নয় কিশোর অপরাধীরা আলামত লুকানোর অভিপ্রায়ে নাইমের লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় পুলিশ ৩ অপরাধীকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে দু’জন ছাত্র।
কিশোর বয়সেই জোড়া খুন করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কিশোর সংশোধনাগারে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে পেশাদার অপরাধী হয়ে ওঠার কাহিনী এরকম। বগুড়া শহরের ফুলবাড়িতে মোজাম্মেল হকের ছেলে ইসমাইল হোসেন আশিক নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ২০০৭ সালের ১৭ জুন শহরের শিববাটিতে বন্ধু রাহিদ ও সুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার পর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিলেও কিশোর হওয়ায় তাকে বগুড়া থেকে কিশোর সংশোধন উন্নয়ন কেন্টেদ্র পাঠানো হয়। কয়েক বছর পর ৫ জনের সঙ্গে আশিকও পাইপ বেয়ে পালিয়ে যায়। পলাতক জীবনেও সে মাদক বিক্রিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয় ।
গত দুই বছরে বগুড়া পুলিশের কাছে মাদক মামলায় সে তিন দফা গ্রেফতার হয়। বগুড়া পুলিশের খাতায় সে এখন এক ভয়ঙ্কর অপরাধী। ভয়ঙ্কর সব অপরাধের পাশাপাশি তারা সংঘবদ্ধভাবে মোটরসাইকেলে উচ্চ শব্দে শহরে বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করে। মেয়েদের স্কুলের প্রবেশ পথ, শপিংমলের আশেপাশে আর কোচিং সেন্টারের চারদিকে অবস্থান করে ইভটিজিং করা নিত্যকরা চিত্র। তবে বরগুনার আলোচিত ‘নয়ন বন্ড’ ঘটনা মিডিয়ায় আসার পর বগুড়ায় সম্প্রতি পুলিশ ও র‌্যাব প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে বেপরোয়া কিশোরদের বাগে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি কমপক্ষে ২০০ কিশোরকে স্পটে ধরে অভিভাবকদের ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া পুলিশের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, অবৈধ পন্থায় বিত্তশালী অভিভাবকরা তাদের কমবয়সী ছেলেদের হাতে খরচ হিসেবে মোটা অংকের টাকা তুলে দিচ্ছেন সেটাই তাদেরকে খারাপ পথে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী সৈয়দ কবীর আহম্মেদ মিঠু ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর- তরুণদের বাঁচাতে চাইলে পাড়া মহল্লায় খেলার মাঠ ও পাঠাগার গড়ায় মনোযোগ দিতে হবে। কমাতে হবে ইন্টারনেট আসক্তি।
বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. তারেক বলেন, জেলায় জেলায় সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ড, বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা আব্দুল হাই বারী বলেন, পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসন থাকলে কিশোর ও তরুণরা বিপথগামী হবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ