পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কক্সবাজার শহরের সাথেই ৬ নম্বর ঘাট। সকালেও রোদের তেজ। সারি সারি স্পিডবোট। গোরকঘাটায় যাচ্ছে জেনে একটিতে উঠে পড়ি। আট জন বসতেই ছেড়ে দিল। ‘প্রকল্পে কাজ করেন নাকি স্যার’? পাশের যাত্রীর প্রশ্ন। বললাম ‘না। ঘুরতে যাচ্ছি’।
যুবক উৎসাহী হয়েই বলতে লাগলেন, ‘মহেশখালী তো আগের মহেশখালী নাই। দ্বীপের এই মাথা ওই মাথা প্রকল্প হচ্ছে। বিরাট বিরাট পাইপ, মেশিন, যন্ত্রপাতি। জায়গাটা নাকি সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে যাবে। বিদেশি লোকেরা দেখাশোনা করছে’। যুবক আজগর আলীর বাড়ি দ্বীপের মাতারবাড়ি ইউনিয়নে। জানালেন, তার পৈত্রিক লবণ চাষের দশ শতক জমি অধিগ্রহণে পড়ে গেছে। সেখানে তাপবিদ্যুৎ মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে।
দ্বীপের উত্তর প্রান্তে মাতারবাড়ি গিয়ে দেখি সত্যিই তো! জলাজমিতে বড় বড় এক্সকেভটর। সমুদ্রের তলার কাদামাটি ড্রেজার দিয়ে তুলে এনে ভরাট ও উঁচু করা হচ্ছে। কোহেলিয়া নদী আর সাগরের মাঝখানে উপদ্বীপের মতো জনপদ মাতারবাড়ি, ধলঘাট। ডানে উত্তর নলবিলা। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় যেখানে হাজারো মানুষের লাশের সঙ্গে ভাসে গবাদিপশুর মৃতদেহ। আজ সেখানেই লবণের মাঠ, চিংড়ির ঘের ছাড়াও প্যারাবনের ওপর পাহাড় সমান মাটির একেকটি স্তুুপ। তার ওপর সমান করা ভ‚মিতে ভারী যন্ত্রপাতি প্রায়ই বসে গেছে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের। চোখ ধাঁধানো অফিস, আবাসিক ভবন। আছে বাণিজ্যিক ব্যাংকের এটিএম বুথ। উঁচু উঁচু রাস্তায় ছুটছে গাড়ি বহর। মরুভূমির মধ্যে কল-কারখানাই মনে হলো। তপ্ত বাতাসের ধূলোবালি এড়াতে দেশি-বিদেশি কর্মী, ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারের লোকজন স্কার্ফের মতো কাপড়ে চোখ-মুখ ঢেকে নিয়ে যার যার কাজে ব্যস্ত।
কক্সবাজার যাত্রার আগে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন-এর নিকট জানা গাইড লাইন মনে রেখেই সরেজমিনে মহেশখালীর পথে পথে এগিয়ে চলি। তিনি পাঠকদের জানাতে চান- কী কী প্রকল্প সেখানে নেয়া হয়েছে, কারা বিনিয়োগকারী, প্রকল্পগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ কিনা, দেশ-জনগণ এতে কী সুফল লাভ করবে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুভূতি।
চারদিকে চোখ মেলে বোঝা গেল, অচেনা সাজে নতুন রূপে সাজছে মহেশখালী দ্বীপ। দেশি-বিদেশি মিলিয়ে এক ডজন কোম্পানির ২২টি প্রকল্প। সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে বাংলাদেশের ঠিক পূর্বকোণে অবস্থিত ৩৮৮ দশমিক ৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের নয়ন জুড়ানো একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ মহেশখালী। যেটি নতুন এক ‘সিঙ্গাপুর’ হতে চলেছে। ধনী দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের আয়তন ৬৯৯ বর্গ কিলোমিটার। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণ, আত্মবিশ্বাস আর উচ্চাভিলাষ পুঁজি করেই নিকট অতীতের হতদরিদ্র জেলেপল্লী বিশ্বের বিস্ময় আজকের সিঙ্গাপুর। প্রকল্পস্থলে কর্মরত জাপানী প্রকৌশলী মাশাকো, চীনা কর্মী লুই টং-সহ কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম কীভাবে কী হচ্ছে মহেশখালীতে। বললেন, ২০১০ সালে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সার্ভে ও গবেষণায় মহেশখালীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উঠে আসে। কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎপ্রকল্প, সমুদ্রবন্দর, শিল্প-বাণিজ্য মিলিয়ে বহুমুখী পথ বেরিয়ে আসে। জাপানের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি)’ উদ্যোগের আওতায় উন্নয়নযজ্ঞ এগিয়ে চলেছে। এ মুহূর্তে সেসব খাতে বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশকারী দেশগুলো হচ্ছে জাপান, চীন, জার্মানী, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, ভারত।
দেশীয় সংস্থা ও কোম্পানির মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), পেট্রোবাংলা, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ বিভাগ, টিকে গ্রæপ, মীর আখতার ইত্যাদি। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)সহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী বিনিয়োগ-শিল্পায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
দেশি-বিদেশি প্রকল্পকর্র্মীরা বললেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফলেই অসাধ্য সাধন হচ্ছে। কেননা বাংলাদেশের মানুষের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রচুর বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন দরকার। এর জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন দুটি ইউনিটে ১২শ’ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎপ্রকল্পের ব্যয় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা জাপানের একক বিনিয়োগ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন গ্রাম-পাড়ায় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বড় বড় প্রকল্পের জন্য জায়গা-জমি ছেড়ে দিয়ে হলেও এলাকাবাসীর চাওয়া দেশ ও দশের উন্নতি।
মহেশখালীর বিভিন্ন অংশে গৃহীত মেগাপ্রকল্প, গুচ্ছ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) ও ডাবল পাইপ লাইনসহ জ্বালানি তেলের ডিপো, অর্থনৈতিক জোন, বহুমুখী সুবিধা সম্পন্ন সমুদ্রবন্দর, বিশেষায়িত পর্যটন কেন্দ্র, স্যাটেলাইট টাউন, ৬ লেইন ও চার লেইন সড়ক, বায়ু বিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় সুপার ডাইক (বেড়িবাঁধ কাম মেরিন সড়ক) নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে। প্রতিটি প্রকল্পে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করেই বাস্তবায়ন কাজে হাত দেয়া হচ্ছে। মহেশখালীতে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প নিশ্চিত করতে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। বেজা’র চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, পাহাড়-টিলায় প্রকল্পের প্রয়োজনে যতগুলো গাছ কাটা পড়বে তার চেয়ে দ্বিগুণ চারগুণ বৃক্ষরোপন করা হবে। এরজন্য অর্থ বরাদ্দ থাকছে।
মাতারবাড়ি ধলঘাট বহুমুখী ব্যবহারের সুবিধাসম্পন্ন গভীর সমুদ্র বন্দর মেগাপ্রকল্প প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সেখানে ১৬ মিটিার ড্রাফটের বড়সড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। এরফলে কন্টেইনার শিপিং পরিবহনে যুগান্তকারী উন্নতি সাধিত হবে। মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গেই সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠবে। সড়ক ও অবকাঠামো সুবিধাসহ বন্দর নির্মাণের প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি একনেকে শিগগির অনুমোদন পাবে আশা করছি।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) নুরুল আলম নিজামী জানান, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য মহেশখালীতে সাড়ে ১৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
হুকুম দখল, লিজ, বন্দোবস্তির জায়গা প্রায় ১২ হাজার একর। এরমধ্যে মাতারবাড়ি ১২শ’ মেগাওয়াট কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৪১৪.৬৫ একর, কালামার ছড়া-হোয়ানকে ১৩,৫৬০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ ও এলএনজি স্টেশনের আওতায় ৫৫৭৯.৬০ একর, চকরিয়া-পেকুয়া-মহেশখালী ৭৯ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইনের (৪২ ইঞ্চি ব্যাসের) জন্য ৭৩.৮১ একর, জ্বালানি তেল সরবরাহে এসপিএম প্রকল্পে ধলঘাটা-কালামার ছড়ায় অধিগ্রহণ ৩২.৪০ একর এবং হুকুম দখল ১৪৪.৫০ একর, ধলঘাটায় অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৪৩৬ একর, কালামার ছড়া-ইউনুছখালী-জাফুয়ায় যৌথ উদ্যোগে ১২শ’ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ১৩৯৩.৯০ একর।
তিনি জানান, অধিকাংশ প্রকল্প ২০২১-২২ সালে চালু হবে। পুরো মহেশখালী স্যাটেলাইট টাউনে পরিণত হবে। ধাপে ধাপে সিঙ্গাপুরের মতোই উন্নতির শিখরে আরোহন করবে। কালামার ছড়া সোনারপাড়ায় সিপিপি-চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো চট্টগ্রামের পতেঙ্গাস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি লি.-এর এসপিএম এবং ডাবল পাইপলাইন নির্মাণ কাজ করছে। প্রকল্পস্থলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চীনা প্রকৌশলী জানান, সমুদ্রে অবস্থানরত তেলবাহী মাদার ট্যাংকার থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল ডিপোতে খালাস, মজুদ এবং সরবরাহ করা হবে। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ প্রকল্পটিতে চীন সরকারের বিনিয়োগ ৪ হাজার কোটি টাকা। পাহাড়-টিলা সমতল করে উঁচু জায়গায় ডিপোসহ তেলের স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণকাজের গুণগত মান তদারক করছে জার্মান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে।
হোয়ানক ধলঘাট পাড়ায় পেট্রোবাংলার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লি. (বিজিটিসিএল)-এর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) স্টেশন নির্মিত হয়েছে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাস থেকে মহেশখালী-পেকুয়া, চট্টগ্রামের আনোয়ারা হয়ে সরাসরি পাইপলাইনে সীতাকুন্ডে জাতীয় গ্রিডে যাচ্ছে গ্যাস। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। শাপলাপুরে নির্মিত হবে আরেকটি এলএনজি স্টেশন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার জানান, মহেশখালীর প্রকল্পগুলো সরকারের অগ্রাধিকার গুরুত্ব বিবেচনায় অধিগ্রহণের জমি টার্গেটের চেয়েও কম সময়ে প্রত্যাশী সংস্থাসমূহকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। মহেশখালী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জ্বালানি কেন্দ্র।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদার হাতে মেগা প্রকল্পগুলো কক্সবাজারবাসীকে দিয়েছেন। মহেশখালী হবে উন্নয়নের গেটওয়ে। এদিকে এসব প্রকল্পের জন্য যারা জায়গা-জমি ও পেশা হারিয়েছেন তাদের উপযুক্ত পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও ঢা.বি. নেতা মহেশখালীর ধলঘাটার বাসিন্দা মোহাম্মদ ওসমান গনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।