Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্মুক্ত ক্রয় প্রক্রিয়া কার্যক্রম বাতিল

প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা মানছে না

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা বাদ দিয়ে ‘সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া’র (ডিপিএম) মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২৬ হাজার ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) উন্মুক্ত ক্রয় প্রক্রিয়ার (ওটিএম) কার্যক্রম শুরু করলেও তা অজ্ঞাত কারণে বাতিল করা হয়েছে। এখন একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ওই সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া ডিপিএম প্রক্রিয়ায় নিম্নমানের ওইসব শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করা হলে এই মুহূর্তে প্রকল্পের প্রায় ৮৭০ কোটি টাকা অবচয় হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে দেশের সব বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ডিজিটালাইজ করা হবে। এজন্য ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে মান যাচাই-বাছাই করেই উপকরণগুলো কেনা হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে পিইডিপি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সংস্থাগুলো হচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইন্টারন্যশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ), ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট (ডিএফআইডি), ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), অস্ট্রেলিয়ান ডিপার্টমেন্ট ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি অস-এআইডি), সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি (সিড), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), ইউনিসেফ, গেøাবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই) ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ডিএফএটিডি) সরকার।

দেশের প্রতি উপজেলায় একটি করে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক ক্লাসরুম পরিচালিত হচ্ছে। এর আলোকেই একসঙ্গে দেশের বিদ্যমান সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অর্থাৎ ৬০ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে ই-লার্নিং ম্যাটেরিয়াল ভিত্তিক ক্লাসরুম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প ৪-এর আওতায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কম্পিউটার অ্যান্ড এক্সেসরিজ স্কুল কর্মসূচির অধীনে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিতরণের জন্য কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেম ক্রয় করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল, যেসব বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ ও আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছে, সেসব বিদ্যালয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

ওইসব বিদ্যালয়ের জন্য এ মুহূর্তে ২৬ হাজার ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার ক্রয়ের লক্ষ্যে গত ৭ মার্চ উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। আগের ক্রয় প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এবার তাদের প্রতিনিধি ছাড়াই গত ২৪ মার্চ প্রি-টেন্ডারিং সভা সম্পন্ন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯ এপ্রিল ওই টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। এখন দরপত্র ছাড়া অর্থাৎ সরাসরি দেশীয় উৎপাদিত পণ্য কেনার চেষ্টা চলছে। অথচ প্রকল্পের প্রতিটি ল্যাপটপের প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার টাকা। কিন্তু এভাবে বেশি মূল্যে পণ্য কেনা হলে তা মানসম্মত না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বুয়েটের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও ডিপিএম প্রক্রিয়ায় টেশিস’র মাধ্যমে চীন থেকে নিম্নমানের পণ্য আমদানির চেষ্টা হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ল্যাপটপ তৈরির। কেউ চাইলে আমরা দিতে পারি। গত বছরও আমরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার ল্যাপটপ দিয়েছি। এ খানে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকারসরবরাহ করতে মতামত দেবার কী আছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, সরাসরি শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা সরকারি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার সরবরাহ করতে পারবে বলে মতামত দিয়েছে। এখন সরকার ডিপিএম করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে বলে তিনি জানান।
তবে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি পণ্য ক্রয়ের তৎপরতা নিয়ে ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও ইতিপূর্বে ওই প্রকল্পে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। ডিপিই’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত রয়েছে, কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথড) অনুসরণ করার। কিন্তু এই প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে প্রায় দেউলিয়া হতে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থার টেশিস) মাধ্যমে নিম্নমানের পণ্য কেনার চেষ্টা করলে সেখানে দুর্নীতি বা লুটপাটের অভিযোগ আসতেই পারে। তাছাড়া টেশিস’র মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প আইসিটি ফেইজ-১ এর অধীনে কেনা প্রায় ২৪ হাজার আইসিটি শিক্ষা উপকরণের অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী একটি সংস্থার প্রতিনিধি ইনকিলাবকে বলেন, ইতিপূর্বে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় পিইডিপি-২ ও পিইডিপি-৩ সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো ৫৭ হাজার ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করেছে। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে কোম্পানিগুলোর দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রয়োত্তর সেবা দিচ্ছে। এই অবস্থায় তাদেরকে বাদ দিয়ে দেশীয় সংস্থার কাছ থেকে শিক্ষা উপকরণ নেয়া হলে তা মানসম্মত হবে না। আবার তারা বিক্রয়োত্তর সেবা দিতে ব্যর্থ হবে। ফলে প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ