Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়ঙ্কর গ্যাং কালচার

তিন বছরে গ্রেফতার ৪০০

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:২৩ এএম

কিশোরদের হিরোইজমের মধ্য দিয়ে গ্যাং কালচার শুরু হলেও এখন ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। মূলত কিশোর বয়সে একটা হিরোইজম চিন্তা-ভাবনা থেকেই গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে রাজধানীসহ সারাদেশে। দিনকে দিন আশঙ্কাজনক হারে দেশজুড়ে- হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে এসব উঠতি বয়সীরা। কিশোর অপরাধের নৃশংসতার মাত্রা তাদের মূল্যবোধ ও মানবিকতাবোধকে নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। প্রতিটি এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠছে আলাদা আলাদা কিশোর গ্যাং। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে।

শুধু তাই নয়, নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা স্ট্যাটাস দেয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুতে তারা একে অপরের সঙ্গে ভাববিনিময় করে। রাজধানীতে এ ধরনের শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। গত তিন বছরে কিশোর গ্যাংয়ের প্রায় ৪শ’ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এর মধ্যে চলতি বছর ১৮৫ জন এবং গত দুই বছরে ১৯০ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করে তারা। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, অপরাধে জড়িত এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। এক হিসাব অনুযায়ী, দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলায় অভিযুক্ত। ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা কিশোর অপরাধ প্রসঙ্গে বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃৃতি, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্য-প্রযুক্তি ও অভিভাবকদের উদাসীনতার কারণে কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, পরিবারের অভিভাবকদের উদাসীনতার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে তারুণ্যের অবক্ষয়ও। বর্তমান রাজনীতি ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজও এজন্য কম দায়ী নয়। সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তির কু-প্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, পাচার, বিরোধ-শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ জন্য দায়ী। এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাও কম দায়ী নয়।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে আরও জোরদার, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কাউন্সিলিং, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কিশোরদের পরিবার সময় দিচ্ছে না। হাতে তুলে দিচ্ছে মোবাইল। ইন্টারনেটের আসক্তির ফলে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তারা। সেখানে অপরাধের নানা কৌশল শিখছে। বিভিন্ন পর্নো সাইটে তারা প্রবেশ করছে। এছাড়া যত ধরনের ভিডিও গেম আছে প্রায় সবগুলোই যুদ্ধ, মারামারী বিষয়ক। অল্প বয়সে খুন, মারামারী-এসব বিষয়ের সঙ্গে একজন কিশোর পরিচিত হচ্ছে। এ ধরনের গেমগুলো কিশোর মনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে।

ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, কিশোর গ্যাং বলি আর বড় গ্যাং বলি, ঢাকায় গ্যাং বলে কোনো শব্দ থাকবে না। সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে ডিএমপি শূন্য সহিষ্ণু নীতি অবলম্বন করেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড়ো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হিসাবে কিশোর গ্যাং দমনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যারা এ ধরনের অপরাধে জড়িত প্রতিটা এলাকাভিত্তিক তালিকা করেছি। তালিকা ধরে ধরে আমাদের প্রতিটা ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। তাদের ওপর নজরদারি রাখা হয়েছে। একদিকে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এছাড়া স্কুল-কলেজের কর্তৃৃপক্ষ ও অভিভাবকদের বার্তা দিচ্ছি। যেন তাদের সন্তানদের বেলায় সতর্ক থাকে। তারা কি করে কোথায় যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমপির উত্তর বিভাগে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং। ওই এলাকায় উল্লেখযোগ্য কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে রয়েছে, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, ডিসকো বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং। কিশোর গ্যাং দ্ব›েদ্ব উত্তরা এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন।

ডিএমপির উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. কামরুজ্জামান সরদার বলেন, কিশোর গ্যাংদের গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে। কোন কোন মোড়ে তারা আড্ডা দেয়, কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে কি না। এছাড়া এলাকাভিত্তিক সন্দেহভাজন কিশোরদের ডেকে এনে কাউন্সিল করে ছেড়ে দেয়। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের ডেকে এনে তাদের জিম্মায় দেই। আর যদি কোনো অপরাধের সঙ্গে কাউকে সম্পৃক্ত পাওয়া যায়। তবে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এছাড়া তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, মিরপুর-১১তে বিহারি রাসেল গ্যাং, মিরপুর ১২তে বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুলর গ্যাং, সি ব্লকে সাব্বির গ্যাং, ডি ব্লকে বাবু রাজন গ্যাং। কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন গ্যাং, তুরাগে তালাচাবি গ্যাং, ধানমন্ডিতে রয়েছে, নাইন এম এম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, রায়ের বাজারে স্টার বন্ড গ্রুপ ও মোল্লা রাব্বি গ্রুপ, মোহাম্মদপুরে গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপায়ইয়া দে গ্রুপ, দক্ষিণখানে শাহীন-রিপন গ্যাং, উত্তরখানের বড়বাগে নাজিম উদ্দিন গ্যাং, আটি পাড়ার শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, খ্রিস্টান পাড়ার সোলেমান গ্যাং, ট্র্যান্সমিটার মোড়ের রাসেল ও উজ্বল গ্যাং, হাজারীবাগে বাংলা ও গেন্ডারিয়ায় লাভলেট, বংশালে জুম্মন গ্যাং, মুগদায় চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি গ্যাং, চকবাজারে টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, গ্যাং কালচারের সঙ্গে বাঙ্গালীদের কোনো সম্পর্ক নাই। এটি একটি ইউরোপীয় কালচার। কিন্তু প্রযুক্তির কারণে সেটা আমাদের সংস্কৃৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। কয়েক দশক আগেও যেমন মা-বাবা তাদের সন্তানদের সঙ্গ দিতেন, সময় ও পরিস্থিতির কারণে এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তারা এক সময় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। সঙ্গ খোঁজতে গিয়ে অনেক সময় খারাপ সঙ্গীর সঙ্গে মিশে যায়। এছাড়া শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ থেকে যে নৈতিকতার শিক্ষা পেত এখন সেটা পাচ্ছে না। কারণ বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ এখন বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বেশি ঝুঁকে পড়েছে।

রাজধানীর হাতিরঝিল থানার ওসি আবদুর রশিদ জানান, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, কটূূক্তি ও যৌন হয়রানির অভিযোগে হাতিরঝিল ও তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত শুক্রবার ১১০ কিশোর-তরুণকে আটক করে পুলিশ। তবে জিজ্ঞাসাবাদের পর শুক্রবার রাতে ও শনিবার ভোরে তাদের মধ্যে ১০৩ জনকে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে মারামারি, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বশেষ রাজধানীতে গত বুধবার রাতে মোহাম্মদপুর চান মিয়া হাউজিংয়ে চাপাতির কোপে মহসিন (১৪) নামের এক কিশোর খুন হয়। এ ঘটনায় তিনজন আহত হয়। মোহাম্মদপুর থানার ওসি গণেশ গোপাল বিশ্বাস বলেন, মহসিন খুনের সঙ্গে জড়িতরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। আধিপত্য বিস্তার ও একটি মেয়েকে কেন্দ্র করে এই খুনের ঘটনা ঘটে। গ্রেফতারকৃত দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে এই তথ্য পাওয়া গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ