পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
প্রভাবশালীদের লোভের গ্রাসে দখল হচ্ছিল বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী-তুরাগ। হাইকোর্ট আদেশে বললেন এই দখলদারিত্ব অবৈধ। উচ্ছেদের আদেশ দেয়া হলো। ট্যানারির বর্জ্যে মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায় ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার। হাইকোর্ট আদেশ দিলেন ট্যানারি স্থানান্তরের। ঈদ উল আযহা এলেই রাজধানীতে যত্রতত্র বসে যেতো পশুর হাট। সিটি করপোরেশন নির্ধারিত স্থান ছাড়া রাজধানীতে কোনো হাট বসতে পারবে না- মর্মে আদেশ দেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় রক্ষা পায় ঢাকার প্রত্মতাত্তি¡ক স্থাপনা লালবাগ কেল্লা।
ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালনা, উচ্চশব্দে হাইড্রোলিক হর্ণ বাজানো নিষিদ্ধকরণ, বিপজ্জনক বিলবোর্ড উচ্ছেদ, ওষুধ এবং শিশুখাদ্যে ভেজাল, পরীক্ষায় নকল রোধ, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় গতিরোধক স্থাপন, সর্বশেষ ডেঙ্গু রোধে হাইকোর্টের আদেশের মতো অসংখ্য অর্জন রয়েছে উচ্চ আদালতের। এসবই জনস্বার্থে দায়ের করা মামলার সুফল। বিচারাঙ্গনে যা ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন’ নামে পরিচিত।
নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার এবং আইনের শাসনের যখন ব্যত্যয় তখনই দায়ের হচ্ছে ‘জনস্বার্থ’র মামলা। এসব মামলায় মানুষ সরাসরি উপকারভোগী। এ কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে জনস্বার্থের মামলা। পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে আইন। মানা হচ্ছে না মানুষের ৬টি মৌলিক অধিকার সম্বলিত সংবিধান।
ব্যক্তি স্বার্থের গন্ডি পেরিয়ে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলা প্রায়ই ঘুরিয়ে দিচ্ছে ঘটনার মোড়। বড় অক্ষরে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। তুমুল হৈ চৈ হচ্ছে। নড়েচড়ে বসছে সরকারের নির্বাহী বিভাগ। দীর্ঘদিনের আইন ও বিধি-বিধানে পরিবর্তন আসছে। বিচারাঙ্গন থেকে মানুষ সরাসরি উপকৃত হচ্ছে জনস্বার্থে (পাবলিক ইন্টারেস্ট) দায়ের করা মামলা থেকে। এসব মামলা বদলে দিচ্ছে অনেক কিছু। এ কারণে জনস্বার্থের মামলা এখন বিচার এবং নির্বাহী বিভাগে ক্রমশ:ই গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে।
জনস্বার্থ মামলার স্বীকৃতি : জনস্বার্থমূলক মামলার ধারণাটি আসে ১৮৬০ সালের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে সেসময় নাগরিকের ‘আইনগত সহায়তা পাওয়া’র আন্দোলন চলছিলো। ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, দক্ষ ও মানবতাবাদী কতিপয় আইনজীবী। উপমহাদেশে জনস্বার্থের মামলাকে চিহ্নিত করা হয় ‘সোশ্যাল অ্যাকশন লিটিগেশন’ হিসেবে।
১৯৫২ সালে ভারতের বিচারপতি সি.জে. মহাজন ‘বিহার রাজ্য বনাম কামেশ্বর’ মামলার রায়ে বলেন, ‘জনস্বার্থ’ ধারণাটির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। এর কোনো স্থির অর্থ নেই। বরং এটি সম্প্রসারণশীল এবং একেক দেশে একেক রকম ব্যাখ্যা রয়েছে ‘জনস্বার্থ’ শব্দের। ‘জনস্বার্থ’ ধারণাটির এমন কোনো পূর্ব নির্ধারিত পরিধি বা ৎসীমারেখা নেই, যার মধ্যে পড়লেই কেবলমাত্র কোনো বিষয়বস্তু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাব দেখাতেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ‘কাজী মুখলেছুর রহমান বনাম বাংলাদেশ’ মামলার শুনানি গ্রহণ করে প্রথম ‘জনস্বার্থ মামলা’র স্বীকৃতি দেন। ‘মোহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ’ মামলায় আপিল বিভাগ বলেন, ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ কথাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় না বরং এটি জনসাধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থাৎ জোটবদ্ধ বা সমষ্টিগত ব্যক্তিত্বকে বোঝায়।
তবে পরোক্ষভাবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি জনস্বার্থে মামলা করতে পারেন। যদিও মামলটি রিট পিটিশন আকারেই দায়ের করতে হয়, কিন্তু এখানে মৌলিক অধিকারগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহকেও নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বাধ্যকরী করার ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। আদালতের বিবেচনায় এটা অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবার জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সাংবিধানিক অধিকার।
ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠির এই সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা মামলার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। জনস্বার্থ এবং জনস্বার্থের চিন্তা মাথায় থাকলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। শুধুমাত্র রিট ও জনস্বার্থ মামলা নয়, যেকোনো মামলার ক্ষেত্রে বিচারকসহ মামলা সংশ্লিষ্ট পক্ষ যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চান তবেই ন্যায়বিচার তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
জনস্বার্থের মামলায় প্রচার ও অর্জন : দেশের উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলার স্বীকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সংবাদপত্রের শিরোনাম হিসেব করে একটি বেসরকারি সংস্থা জানায়, উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলার সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। নাগরিক সঙ্কট বৃদ্ধি, নিত্য নতুন আইন-প্রণয়ন এবং অধিকার লঙ্ঘনের হার বাড়ায় প্রতিদিন বাড়ছে জনস্বার্থের মামলার সংখ্যা।
তবে সব জনস্বার্থের মামলায়ই যে উচ্চ আদালত থেকে প্রতীকার মেলে এমনটি নয়। বেশিরভাগ মামলাই দায়েরের পর সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। রিট ফাইল, প্রাথমিক শুনানি, রুল জারি এবং রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদেশ প্রদান পর্যন্ত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে প্রচার পায় জনস্বার্থের কিছু কিছু মামলা। এ মামলার সুবাদে মিডিয়া কাভারেজ পেয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের কয়েকজন আইনজীবী রীতিমতো তারকা বনে গেছেন।
২০০৬ সালে জনস্বার্থে মামলা করে ‘রিট মাস্টার’ উপাধি পান মরহুম অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান। তিনি ‘হরতাল অবৈধ ঘোষণা, আদালত অঙ্গনে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি রাজনৈতিক বিষয়ে রিট করতেন। এসব রিট এবং এ প্রেক্ষিতে রুল ও নির্দেশনা বিচারাঙ্গনে উত্তাপ ছড়ায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাসংক্রান্ত আইন নিয়ে জনস্বার্থে বহু মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবিএম নূরুল ইসলাম। বয়সের ভারে ন্যূব্জ এই আইনজীবী এখন আর জনস্বার্থে মামলা করছেন না। সর্বশেষ ব্যক্তিগত গাড়িতে বাম্পার লাগানো অবৈধ ঘোষিত হয় তার মামলায়।
গত এক দশকে জনস্বার্থে মামলা করে ব্যপক পরিচিতি পেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি সর্বাধিক ৩শ’ জনস্বার্থ মামলার আইনজীবী। ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’ নামক একটি সংস্থার পক্ষে তিনি মামলা পরিচালনা করেন। এর মধ্যে অন্তত: ৬০টি মামলায় প্রতীকার মিলেছে। অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের বেশিরভাগ মামলাই আলোচিত ও প্রশংসিত।
ঢাকার চারপাশে চার নদী রক্ষার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তার মামলার রায়ে। কর্ণফুলি নদীসহ ৬০/৭০টি নদী ও খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বরিশালের ‘জেলখাল’ রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয় মনজিল মোরসেদের মামলায়। লালবাগ কেল্লা, মহাস্থানগড়, রেসকোর্স ময়দানের মতো ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শন রক্ষার নির্দেশনা এসেছে তার মামলায়। বিভিন্ন নদী, খাল-বিলের পানিদূষণ রোধ, হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তর ও স্বাস্থ্য বিষয়েও মামলা করে জনস্বার্থে রায় পেয়েছেন মনজিল মোরসেদ। ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে ৭০ শিশুর মৃত্যু বিষয়ে তিনি মামলা করে নির্দেশনা পেয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপদগ্রস্ত প্রবাসীদের জন্যও মনজিল মোরসেদ তার সংগঠন থেকে আইনি সহযোগিতা দেন। জনস্বার্থের মামলা সম্পর্কে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আমরা একেবারে জনস্বার্থে মামলাগুলো করেছি। কারণ মানুষ নানা সংকটে আবর্তিত হচ্ছে। প্রতীকার চাওয়ার জায়গা নেই। আমরা এইচআরপিবি’র জনসাধারণের পক্ষে মামলাগুলো করছি। এসব মামলা পরিচালনায় অনেক প্রতীকূলতা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশ কয়েকবার হত্যার হুমকিও দিয়েছেন প্রভাবশালীরা। এসবের তোয়াক্কা না করেই মামলা চালাচ্ছি। সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই গাড়ি রিকুইজিশনের ক্ষেত্রে ৯ দফা নির্দেশনা এসেছে আমাদের রিট থেকে।
গত কয়েকবছরে জনস্বার্থে মামলা করে আলোচনায় এসেছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ সকল রাজনৈতিক দলের সংলাপ চেয়ে রিট করে ২০১৩ সালে আলোচনায় আসেন তিনি। ৬৭ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের স্বপদে বহাল থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধ হয় ইউনুছ আলী আকন্দের জনস্বার্থ রিটের পর। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের কমিটির সভাপতির পদে স্থানীয় এমপিদের থাকা নিয়ে জনস্বার্থে রিট করে রায় পান তিনি।
এরকম বেশকিছু সুফল আসে ইউনুছ আলী আকন্দের মামলা থেকে। তবে আদালতের রায় সংবাদ মাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করায় ২০১৪ সালে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ তাকে ১০হাজার টাকা জরিমানাও করেন। অ্যাডভোকেট অমিত দাশ গুপ্ত, ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের মতো তরুণ আইনজীবীও সম্প্রতি জনস্বার্থে মামলা করতে এগিয়ে আসছেন। এছাড়া বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি জনস্বার্থে মামলা করছে।
বাড়াচ্ছে মামলা জট : সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী মুহাম্মদ রেজাউল করিমের মতে, জনস্বার্থের বেশিরভাগ মামলাই দায়ের হয় বাদী এবং তার আইনজীবীর সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে। প্রতীকারের চেয়ে মিডিয়া কাভারেজ হয়ে ওঠে মুখ্য। পাবলিক ইন্টারেস্টের অধিকাংশ মামলাই পরে খারিজ হয়ে যায়। মাঝখানে কেবল আদালতের মামলা জট বাড়ে। সরকারের প্রশাসনকে অকারণ চাপের মুখে ফেলে। আদালতেরও সময় নষ্ট হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।