Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ত্যাগ চাই মার্সিয়া ক্রন্দন চাহি না

মুহাম্মদ সানাউল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

ফিরআউন মূসা -কে বললো: হে মূসা! তুমি কি তোমার জাদুর জোরে আমদেরকে দেশ থেকে বের করে দেবার জন্য আগমন করেছ? তাহলে আমরাও তোমার মোকাবিলায় তোমার নিকট অনুরূপ জাদু উপস্থিত করবো। অতএব আমাদের ও তোমার মধ্যে কোন একটি উন্মুক্ত মাঠে একটা ওয়াদার দিন ধার্য্য কর, যার খিলাপ আমরাও করব না তুমিও করবে না। মূসা (আ.) বললেন : তোমাদের ওয়াদার দিন হবে তোমাদের উৎসবের দিন এবং সেদিন পূর্বাহ্নেই লোকজন সমবেত হবে।

দিন ধার্য হবার পর ফিরআউন তার শহরের জাদুকরদের একত্র করার পর বললো! তোমরা তোমাদের সকল কলাকৌশল প্রয়োগ কর। তোমরা সারিবদ্ধভাবে এসো। আজ যে জয়ী হবে সেই হবে সফলকাম।

জাদুকরগণ ফিরআউনের নিকট সমবেত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, জাদুকর ব্যক্তিটি কী দিয়ে জাদু করে? সবাই বললো, সাপ দিয়ে। তারা বললো, আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমাদের উপরে এমন কেউ নেই, যে লাঠি ও রশিকে সাপ বানিয়ে কাজ করতে পারে। অতএব আমাদের জন্য কি বিশেষ কোন পুরস্কার আছে যদি আমরা বিজয়ী হই? সে বললো হ্যাঁ। তখন অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। জাদুকরগণ উৎসাহিত হয়ে মূসা -কে বললো হে ম‚সা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর, না হয় আমরা প্রথমে নিক্ষেপ করব।

মূসা (আ.) বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করলো তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাঁধিয়ে দিলো এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল ও এক মহাজাদু প্রদর্শন করল।

তাদের জাদুর প্রভাবে মূসার মনে হল যেন তাদের রশি ও লাঠিগুলো (সাপের ন্যায়) ছুটাছুটি করছে। তাতে মূসা (আ.)-এর মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হলে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ.)-কে অভয় দিয়ে বললেন : হে মূসা! তুমি ভয় পেয়ো না, তুমিই বিজয়ী হবে। তুমি তোমার ডান হাতের লাঠি নিক্ষেপ কর, (দেখবে) তারা যা কিছু তৈরি করেছে এটা তা সব গিলে ফেলবে। তারা যা তৈরি করেছে তাতো কেবল জাদুকরের কৌশল। জাদুকর যেখানেই আসুক সফল হয় না।

মূসা (আ.) তার লাঠি নিক্ষেপ করতেই তা একটি বিরাট অজগর সাপ হয়ে যাদুর সাপগুলোকে গিলে ফেললো। ফিরআউনের যাদুকরেরা (তা দেখে) সেজদায় পড়ে গেল। তারা বললো, আমরা হারুন ও মূসার রবের প্রতি ঈমান আনলাম।

এভাবেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হল। মহান আল্লাহ বলেন : ‘অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং বাতিল হয়ে গেল তাদের সমস্ত জাদুকর্ম। এভাবে তারা সেখানেই পরাজিত হল এবং লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল। সূরা আ‘রাফ : ১১৮, ১১৯। পরাজয়ের এ দৃশ্য দেখে ভীত ফিরআউন নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত জনতার সামনে জাদুকরদের উদ্দেশে বললো : ‘আমার অনুমতিদানের প‚র্বেই তোমরা তাকে মেনে নিলে? নিশ্চই সে (ম‚সা) তোমাদের প্রধান, সেই তোমাদের জাদু শিক্ষা দিয়েছে।’ সূরা শো‘আরা : ৪৯।

অতঃপর ফিরআউন সম্রাটসূলভ হুমকি দিয়ে জাদুকরদের বললো : ‘আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াবো। সূরা শো‘আরা : ৪৯। জবাবে জাদুকরগণ বললো : ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের রবের কাছে প্রত্যাবর্তন করব। আশাকরি আমাদের রব আমাদের ক্রটি বিচ্যুতিসমূহ ক্ষমা করবেন।’ সূরা শো‘আরা : ৫০-৫১।

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, উবায়দ ইবনু উমায়ের ও অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন : যারা সকালে জাদুকর ছিলো তারা সন্ধ্যায় শহীদ হয়ে গেল। জাদুর পরীক্ষায় পরাজিত ফিরআউনের যাবতীয় আক্রোশ গিয়ে পড়ল এবার নিরীহ বনু ইসরাঈলদের উপর। জাদুকরদের ঈমান আনয়ন অতঃপর তাদের মৃত্যুদন্ড প্রদান এ ধরনের নিষ্ঠুর দমননীতি ও মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে মূসা (আ.)-এর ঈমানী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার চক্রান্ত করেছিল ফিরআউন। কিন্তু এর ফলে মূসা (আ.)-এর দাওয়াত জনগণের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। তাতে ফিরআউন ও তার অহঙ্কারী পরিষদবর্গ নতুনভাবে দমন নীতিকৌশল প্রণয়ন করলো। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এ-নীতির অনুসরণে ফিরআউন ক্বিবতী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কেবল বনু ইসরাঈলদের ওপরে চ‚ড়ান্ত যুলুম ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করলো। মূসা (আ.)-এর জন্মকালে বনু ইসরাঈলের সকল নবজাতক পুত্র হত্যা করে ফেলে আসা লোমহর্ষক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি শুরু করলো। নির্যাতনের শিকার বনু ইসরাঈলগণ মূসা (আ.)-এর নিকটে অনুযোগের সুরে বললো : ‘তোমার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে, তোমার আগমনের পরেও তাই করা হচ্ছে।’ সূরা আ‘রাফ : ১২৯।

মূসা (আ.) তাদের বললেন : ‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর কাছে এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এ পৃথিবী আল্লাহর। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। আর চ‚ড়ান্ত পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত। সূত্র : আ‘রাফ : ১২৮।

ফিরআউন যখন একের পর এক বনু ইসরাঈলদের প্রতি জুলুম অত্যাচার চালাতেই থাকে তখন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ.)-কে মিসর ত্যাগ করার নির্দেশ বা অনুমতি দেন। তিনি বলেন : ‘আমরা মূসার প্রতি এ মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাতে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্ক পথ নির্ধারণ কর। পেছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশঙ্কা এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয় করো না। আল্লাহর হুকুমে মূসা রাতের সূচনালগ্নে বনু ইসরাঈলদের নিয়ে সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হলেন। সকালে ফিরআউন মূসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের মিসর ত্যাগের খবর পেয়ে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইসরাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলো। অতঃপর যখন তারা উভয় দল পরস্পরকে দেখতে পেল তখন মূসা (আ.)-এর সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলে উঠলো, আমরা এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম। ম‚সা বললেন : কখনই নয়, আমার সাথে আছে আমার পালনকর্তা। তিনি সত্বর আমাকে পথ প্রদর্শন করবেন।

অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড়ের রূপ ধারণ করল। ইতোমধ্যে আমরা সেখানে অপর দলকে (ফিরআউন ও তার সেনা দলকে) পৌঁছে দিলাম এবং মূসা (আ.)-ও তাঁর সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম। আর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম। সূরা শো‘আরা : ৬০-৬৬।

সাগর ডুবির এ ঘটনা ঘটেছিল ১০ই মুহাররমে। ইবনু আব্বাস হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল (স.) মদীনায় এসে দেখতে পেলেন, ইয়াহুদীরা আশুরার সাওম পালন করছে। তিনি এ ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বললো : এ দিন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ.)-কে ফিরআউনের উপর বিজয় দিয়েছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন : তোমরা মূসা (আ.)-এর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের চাইতেও বেশি হকদার। সুতরাং তোমরাও এ দিনে সাওম পালন কর।

অতএব আশুরার সিয়াম পালনের সম্পর্ক মূসা (আ.) এবং বনু ইসরাঈলের মুক্তির সাথে। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা তথা হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের সাথে আশুরার সিয়ামের কোন সম্পর্ক নেই। যদিও পরবর্তীতে মুহাররামের ১০ তারিখেই হুসাইন শহীদ হন। #

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ