Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা অক্টোবরে

সাগরে নিম্নচাপে স্বাভাবিক বর্ষণ অস্থায়ী বন্যার আভাস এ মাসে পূর্বাভাস ও বাস্তবে গরমিল!

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

চলতি সেপ্টেম্বর মাসে (ভাদ্র-আশি^ন) দেশে বৃষ্টিপাত হতে পারে স্বাভাবিক হারে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক বা দুটি মৌসুমী নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। নিম্নচাপের প্রভাবে অনেক জায়গায় ভারী বর্ষণের হতে পারে। তাছাড়া এ মাসে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কতিপয় স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে দেশের অন্যত্র প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি প্রবাহিত হতে পারে বিপদসীমার নিচ দিয়ে।

গতকাল (রোববার) আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস প্রদানের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভা সূত্রে একথা জানা গেছে। সভায় আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত, মানচিত্র, জলবায়ু মডেল, এল-লিনো এবং লা-নিনা অবস্থা ইত্যাদি উপাদান পর্যালোচনা করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন আহমেদ।

এদিকে আবহাওয়া বিভাগের ত্রৈমাসিক (আগস্ট-অক্টোবর) অপর এক পূর্বাভাসে জানানো হয়, আগামী অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতীতের দুর্যোগসূচি অনুসারে সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর (আাশ্বিন-কার্তিক) মাসে এ দেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা থাকে। বঙ্গোপসাগরে তখন ঘূর্ণিঝড়ের ঘনঘটা তৈরি হয়। অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বর্ষার মৌসুমী বায়ু বিদায় নেবে।

আবহাওয়া বিভাগের পর্যালোচনা অনুযায়ী, গত আগস্ট (শ্রাবণ-ভাদ্র) মাসে সারাদেশে গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে বিভাগওয়ারি হিসাবে ঢাকায় ২২.৮ ভাগ কম বৃষ্টি ঝরেছে। ঢাকা বিভাগে আগস্ট মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ধরা হয় ৩১২ মিলিমিটার। তবে বৃষ্টি হয়েছে ২৪১ মি.মি.।

চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪.৩ ভাগ কম, সিলেট বিভাগে ৩৫.৭ ভাগ কম, রাজশাহী বিভাগে ৩৫.৪ ভাগ কম, রংপুর বিভাগে ৩৫ ভাগ কম এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪২.৫ ভাগ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে বৃষ্টি ঝরেছে স্বাভাবিকের কাছাকাছি। যথাক্রমে ৬ ভাগ বেশি এবং ৯.৩ ভাগ কম।

বিগত জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসে সমগ্র দেশে সার্বিক গড় বৃষ্টিপাত হয় স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫.৮ ভাগ বেশি। তবে গত মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫.২ ভাগ কম এবং জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) মাসে ৩৭.৭ ভাগ কম বৃষ্টি ঝরে।

পূর্বাভাস ও বাস্তবে গরমিল!
আবহাওয়া বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে গত আগস্ট (শ্রাবণ-ভাদ্র) মাসে ‘বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি’ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা জানানো হয়েছিল তবে বাস্তবে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তো নয়ই; বরং ২৩.২ শতাংশ কম। মৌসুমী ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাসও কার্যত সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসেও ‘উত্তর-পূর্ব ভারত, বিহার ও নেপালসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আগস্টের শেষভাগে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকির কথা বলা হয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল পর্যালোচনায় জানায়, বৃষ্টিপাতের দিন সংখ্যা, লঘুচাপ এবং কৃষি আবহাওয়া আগস্ট মাসের পূর্বাভাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

আগস্ট মাসের তাপদাহ ও অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, গেল মাসে বঙ্গোপসাগরে অন্তত ৪টি লঘুচাপ এবং একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। তবে সেগুলো বাংলাদেশের অভিমুখে এগিয়ে আসেনি। বরং দিক পরিবর্তন করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার দিকে অগ্রসর এবং দুর্বল হয়ে কেটে যায়। ৫ আগস্ট উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ৮ আগস্ট গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ভারতের ঝাড়খন্ডে কেটে যায়। আবার কোনো কোনোটি পশ্চিমা মৌসুমী বায়ুর বলয়ের সাথে মিলিত হয়। এভাবে পশ্চিমা লঘুচাপগুলো উত্তর বঙ্গোপসাগর থেকে বর্ষার মেঘমালা শুষে নেয়। বাংলাদেশে খরা, অনাবৃষ্টি ও তাপদাহ বিরাজ করে মাসজুড়ে। যদিও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দেশের কোনো কোনো স্থানে (অল্প পরিসরে) ভারী বৃষ্টি হয়। যেমন- গত ২৩ আগস্ট টেকনাফে সর্বোচ্চ ২২২ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।

অস্বাভাবিক তাপদাহ
বিশ্বে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমানতালে বাংলাদেশেও পারদ উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। গত আগস্ট মাসে একদিকে বৃষ্টিপাতে ঘাটতি বা অসময়ে খরা-অনাবৃষ্টি অন্যদিকে অস্বাভাবিক মাত্রায় তাপদাহ লক্ষ্য করা যায়। গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তরে বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যালোচনা অনুসারে, দেশে আগস্টে মাসে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে ছিল। গেল মাসের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং শূন্য দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গত ১২ আগস্ট দিনাজপুরে ৩৮.৪ ডিগ্রি সে.।

গত জুন, জুলাই মাসেও তাপমাত্রার পারদ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে। জুলাইয়ে দেশে গড় তাপমাত্রা (দিনের সর্বোচ্চ ও রাতের সর্বনিম্ন) স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শূণ্য দশমিক ৪ ডিগ্রি সে. বেশি ছিল। জুন মাসে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে ১.৮ ডিগ্রি ও ০.৬ ডিগ্রি সে. ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। এ অবস্থা বাংলাদেশের আবহাওয়া-প্রকৃতির ক্রমাগত তপ্ত হয়ে ওঠা এবং খরা-অনাবৃষ্টির প্রবণতা বা সূচক বহন করছে।

এ সপ্তাহ কেমন যাবে-
চলতি সপ্তাহের ( ১ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর) কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, এ সপ্তাহে দৈনিক উজ্জ্বল সূর্য কিরণকাল সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ ঘণ্টার ঘন্টার মধ্যে থাকতে পারে। এ সপ্তাহের দুই বা তিন দিন খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক স্থানে এবং দেশের অন্যত্র কিছু কিছু জায়গায় হালকা (দৈনিক ৪ থেকে ১০ মি.মি.) থেকে মাঝারি ধরনের (১১ থেকে ২২ মি.মি.) বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী (২৩-৪৩ মি.মি.) বর্ষণ হতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

অসহনীয় তাপদাহ লঘুচাপের আশংকা
অসহনীয় ভ্যাপসা গরমে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেঘ-বৃষ্টি নেই। শুধুই চৈত্র-বৈশাখের মতো তীব্র গরম যেন কাঁটার মতো শরীর ফুঁটো করছে। বাতাসেও মরুর আগুনের হলকা। অসময়ের এ তাপদাহে ঘরে ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ।

এদিকে আবহাওয়া বিভাগ জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর বঙ্গোপসাগরে এবং এর সংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টির আশংকা রয়েছে। এটি বর্ষার মৌসুমী বায়ুর মেঘমালা ধারণ করে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে স্বস্তির বৃষ্টিপাতের আশা রয়েছে। তবে পশ্চিমা লঘুচাপ আকারে ভারতের উপকূল হয়ে স্থলভাগের দিকে কেটে গেলে বৃষ্টির আশা ক্ষীণ।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল ছাড়া সমগ্র দেশ ছিল প্রায় বৃষ্টি-বাদলহীন টানা খরার দহনে তপ্ত খটখটে। তাপমাত্রার পারদ উঠে গেছে ৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সিলেটে। ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬.৩ এবং সর্বনিম্ন ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের অনেক জেলায় পারদ উঠে গেছে ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রিতে।

উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরমে-ঘামের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রা। চামড়ায় ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে তীর্যক সূর্যের দহনে। গতকাল ঢাকার বাতাসে জলীয়বাষ্পের হার ছিল সকালে ৯৩ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬৭ শতাংশ।

আজ (সোমবার) সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা ও অন্য বিভাগগুলোর কিছু কিছু জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে।

সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এরপরের ৫ দিনে আবহাওয়ায় কিছুটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ