Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

ঈদে অর্থপ্রবাহ বাড়ে কোরবানির পশু, পরিবহন, চামড়া কামারশিল্প, পর্যটন-বিনোদনসহ অসংখ্য খাতে

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ঈদকে ঘিরে বহুমাত্রিক লেনদেনের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি হয়েছে চাঙ্গা। কোরবানি মহান এবাদত ও ধর্মীয় ফরজ। অর্থনীতি বিশারদদের কথা, কোরবানির অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিরাট। ঈদ অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। যার শতকরা ৯৫ ভাগই গ্রামমুখী। শুধু ঈদের দিন নয়, আগে ও পরে টানা পক্ষকাল বিভিন্নখাতে অর্থনৈতিক লেনেদেন হয়েছে ব্যাপক। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল রেকর্ড পরিমাণ। ঈদে কর্মস্থল থেকে জন্মস্থানের মাটি স্পর্শ করতে যাতায়াত, কোরবানির গরু ও ছাগল লালন-পালন, ক্রয়-বিক্রয়, আনুষঙ্গিক খরচাদি, কোরবানির দিনে ঝুড়াকুটা ও আনন্দে ঘুরে বেড়ানোসহ বিভিন্নভাবে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

এবারই সম্পূর্ণ দেশি পশুতেই কোরবানি সম্ভব হয়েছে। দেশের টাকা দেশেই লেনদেন হয়েছে। অন্যবারের মতো ভারতের গরু ক্রয়ে দেশের অর্থ পাচার হয়নি। বাংলাদেশ এখন পশুসম্পদে সমৃদ্ধ। অর্থনীতির তত্তে¡ জাতীয় ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, উৎপাদন, ভোগ, কর্মসংস্থান, কেনাকাটা, বিনিয়োগ, নগদ লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কমবেশি সবার হাতে টাকা পৌঁছানোসহ সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থা সামষ্টিক অর্থনীতি। ধনী-গরীব সকল পর্যায়ের মানুষের মাঝে ঈদ অর্থনীতির ছোঁয়া লেগেছে। টাকা সরবরাহ ও লেনদেনসহ আর্থিক কর্মকান্ডের প্রসার এবং প্রভাবই অর্থনীতির আয়। কোরবানির ঈদে সেটিই হয়েছে। বিরাট গতিশীলতা এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।

বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডায়ালগ (সিপিডি) সূত্র জানায়, ঈদকেন্দ্রিক পবিত্র হজ, কোরবানি, পরিবহন, পর্যটন ও বিনোদনসহ বিভিন্ন খাতে অর্থনেতিক কর্মকান্ড অনেক বেড়েছে। বেড়েছে গ্রামমুখী টাকার প্রবাহ। যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মো. নাসিম রেজা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা হয়েছে। গ্রামেই সিংহভাগ মানুষ গরু-ছাগল কোরবানি দিয়েছেন। আনুষঙ্গিক বহু বিষয় জড়িত এই ঈদে। ধর্মীয় কোন উৎসবে এতো পরিমাণ লেনদেন সাধারণত হয় না। গরু-ছাগল ক্রয়-বিক্রয়, পশু খাদ্য, গ্রামে ফেরা ও চামড়া বেচাকেনার বিষয় আছে। যারা কোরবানি দেননি তারাও গোশত পেয়েছেন। বলা যায় প্রায় সবার ঘরে ঘরে গোশত রান্না হয়েছে। পিঁয়াজ, রসুন, তেল, মসলাসহ রান্নাবান্নার জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়ে প্রচুর নগদ টাকার লেনদেন হয়েছে। কোরবানির ঈদে গ্রামে গ্রামে এক ভিন্ন দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। গ্রাম ফিরে পায় নতুন প্রাণ।

গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) শেখ আজিজুর রহমানের বক্তব্য, সারাদেশে কোটিরও বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। সম্পূর্ণ দেশি পশুতেই কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, একেবারে পিওর দেশি। ক্রসবিড খুবই কম। গরু-ছাগল এখন সারপ্লাস। উত্তরবঙ্গে প্রচুর কোরবানির পশু অবিক্রিত রয়েছে। তিনি জানান, চট্টগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুরসহ সারাদেশে বর্তমানে ৬৭ হাজার খামার রয়েছে। এর বাইরেও প্রায় অর্ধকোটি কৃষক পরিবার গরু ছাগল পালন করেন। গ্রামবাংলার বাড়িবাড়ি গরু ও ছাগল লালন পালন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। শুধু কোরবানি নয়, সারা বছরের গোশতের চাহিদা পূরণ হচ্ছে দেশে উৎপাদিত গরু ও ছাগলে। দেশের উন্নয়নে সেক্টরটি বিশেষ অবদান রাখছে।
সূত্র জানায়, মাথাপিছু পুষ্টির হার ৮০% যোগান দেয় গরুর দুধ। আমিষের ঘাটতি পূরণ ও গরুর গোশত ছাড়াও চামড়া, লোম, হাড় ও বর্জ্য কোনকিছুই ফেলনা নয়। গরুর হাড়ে প্রচুর ক্যালসিয়াম। আপাতত পোলট্রি ও ফিস ফিড করা হচ্ছে। রিসার্চ চলছে ভিন্ন কিছু করার। পশমে হচ্ছে কম্বল। বর্জ্যে হচ্ছে জৈব সার। চামড়ায় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে পশুসম্পদ। গড়ে তুলছে আর্থিক নিরাপত্তা।

পরিবহন খাতে চাঙ্গাভাব
দুই ঈদে সবচেয়ে বেশি আলোচিত পরিবহন খাত। মানুষ দুই ঈদে, বিশেষ করে বড় ঈদ নামে পরিচিত কোরবানির ঈদে পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ করতে কর্মস্থল থেকে নিজেদের বাড়িতে বেশি যান। এসময় বাস, ট্রেন, লঞ্চ এমনকি বিমান পরিবহনের চাঙ্গাভাব দেখা দেয়। মানুষ তার আয়ের বড় একটা অংশ ব্যয় করেন পরিবহনের জন্য। এর ফলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে ট্রান্সপোর্ট। হাজার হাজার কোটি টাকা এহাত-ওহাত হয় এ খাতে।

রেকর্ড রেমিট্যান্স
কোরবানির ঈদে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অর্থনৈতিক লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এসেছে জুলাই মাসে। যার পরিমাণ প্রায় ১শ’ ৬০ কোটি ডলার। কোরবানির ঈদের জন্যই রেমিট্যান্স বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
চামড়া শিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতি
চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, কোরবানির পশুর চামড়া থেকেই মূলত দেশের মোট চামড়ার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। কোরবানির চামড়ার অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে. সারা বছরের খরচের একটা বড় অংশ ওঠে মাদরাসা ও এতিমখানার। চামড়া খাতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এবার ব্যাংক ঋণ দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।

ঈদবোনাসের প্রবাহ
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সরকারী ও বেসরকারী, মিডিয়া, শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ চাকুরীজীবী এবং শ্রমিকরা যে ঈদবোনাস পেয়েছেন তার সিংহভাগই ব্যয় হয়েছে কোরবানিতে। কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ে লেনদেন সবচেয়ে বেশি। নাড়ির টানে জন্মস্থানের মাটিতে কোরবানি করার জন্য লাখ লাখ লোক বাস, ট্রেন, স্টিমার, লঞ্চ ও বিমানসহ পরিবহন খাত ব্যবহার করায় কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।

বিভিন্ন সেবায় চাঙ্গাভাব
বছরের একটি দিনের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। কোরবানিতে ব্যবহৃত দা, ছুরি, বঁটি ক্রয়-বিক্রয়েও কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। গোশত, সেমাই, পোলাও রান্নার জন্য মসলাসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়েও কম লেনদেন হয়নি। গ্রামের মুদি দোকান পর্যন্ত জনজমাট বিকিকিনি হয়েছে কোরবানির ঈদে। ঈদগাহ ময়দান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছাউনী দেয়া, কোরবানির গরু হাট ইজারা নেওয়া, বাঁশ খুঁটির ব্যবহার, দোকানপাটে বাড়তি চাপ ঠেকাতে ও গরু-ছাগল ঝুড়াকাটায় খন্ডকালীন লোক নিয়োগসহ বিশাল এক কর্মযজ্ঞে গ্রামে গ্রামে নগদ টাকার লেনদেন হয়েছে প্রচুর। এ ঈদে শিশুদের জামা কাপড়, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী বেচাকেনা হয়েছে উল্লেখযোগ্য।

গ্রামের মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে ও খোলামেলা জায়গায় জটলা বেঁধে উঠতি বয়সের যুবকরা আনান্দ উল্লাসে ও বিভিন্নভাবে প্রচুর টাকা খরচ করেছে। ঈদে লম্বা ছুটি পেয়ে লাখ লাখ মানুষ নির্মল আনন্দের জন্য কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সিলেট, বান্দরবান, রাজশাহীর পদ্মাপাড় ও সুন্দরবনে ভ্রমণ করেন। পর্যটন খাতে হয় বিপুল অর্থের লেনদেন।

বিনোদন স্পটকেন্দ্রিক অর্থপ্রবাহ
ঈদের দিন ছাড়া টানা কয়েকদিন দেশের বিভিন্নস্থানের বিনোদন স্পট ছিল লোকে লোকারণ্য। কোরবানির ঈদে প্রায় সবার হাতেই নগদ টাকা ছিল। তাই মনের আনন্দে মানুষ ঈদ উৎসবে ছিল মাতোয়ারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের প্রত্যেক এলাকার গ্রামে গ্রামে ঈদকে ঘিরে শুধু বিপুল অংকের অর্থ লেনদেন হয়নি, প্রতিটি গ্রাম পরিণত হয় ধনী-গরীব সকল মানুষের এক মহামিলন মেলায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ