বেদনার ধ্বনি শুনতে পাই
সত্যি বিচিত্র এ দেশ, বিচিত্র এ দেশের মানুষের মনন ও মানসিকতা। সীমাহীন আত্মত্যাগ ও অজস্র
যেকোনো দেশের ধর্মীয় শিক্ষার সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে সে দেশের সরকারের ধর্মচিন্তা এবং ধর্মবিষয়ক উন্নয়ন কর্মকান্ডের ওপর। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের সম্প্রসারণ, ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার-প্রসারে যে সীমাহীন অবদান রেখে গেছেন, তা সমকালীন মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে চিরকাল। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ইসলাম শিক্ষা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান ও মুসলমান সম্পর্কীয় বিষয়গুলোর ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, বেতার ও টিভিতে কোরআন তিলাওয়াত ও তরজমা পেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, কাকরাইল মসজিদের জন্য অতিরিক্ত জায়গা বরাদ্দ, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য স্থান নির্ধারণ, বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) উদযাপন এবং মদ, জুয়া ও লটারি নিষিদ্ধ করা ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান।
মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবমূল্যায়ন নিরসনকল্পে এবং মান-সম্মান বৃদ্ধি করতেই বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে ৬৪টি জেলায় এর শাখা রয়েছে। ১৯৯৮ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে এ পর্যন্ত এর আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত রয়েছে; বিশেষ করে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম ধর্মপ্রাণদের সেবায় নিবেদিত হয়ে কাজ করছে। লাখ লাখ শিশু নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ইসলামী শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং এর সফল প্রচার-প্রসারের জন্য মাদ্রাসা বোর্ড পুনর্গঠন করেছিলেন। তিনি দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পরই তাঁর কাছে অভিযোগ এসেছিল, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসাসহ আলেম-উলামারা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। সে কারণে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে ঢাকা আলিয়ার ছাত্রাবাস আল্লামা কাশগরি হল মসজিদে এসে শিক্ষকদের নিয়ে বসে বিস্তারিত শুনলেন এবং জানলেনও। জানার পর দেখলেন, কিছুসংখ্যক চিহ্নিত সুবিধাভোগী লোক ছাড়া ঢাকা আলিয়াসহ সারা দেশের উল্লেখযোগ্য হকপন্থী কোনো আলেম স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেননি। এরপর তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েই মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমতি দিয়েছিলেন। বর্তমানে এমপিওভুক্ত এসব আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। বর্তমান আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা সম্ভব হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো সরকারি দান-অনুদান, মাদ্রাসা বোর্ড ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রণীত কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান করছে। বলতে হয়, আজ মাদ্রাসা শিক্ষায় এ আলিয়া ধারার সংখ্যাধিক্য, ব্যাপক বিস্তৃতি ও স¤প্রসারণ কাজ বঙ্গবন্ধুর উন্নত ধর্মীয় মানসিকতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি মুসলমানদের সমাজ জীবনে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যেসব অবদান রেখেছেন, পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছরে এর এক ভাগও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাবলিগ জামাতের কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য রমনা পার্কের কিছু জায়গার প্রয়োজন পড়ে। তখন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পার্কের অনেকখানি জায়গা কাকরাইল মসজিদকে দেয়ার সুব্যবস্থা করে দেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার জন্য সরকারি জমি প্রদান করেন এবং ইজতেমার পরিধি আরো বড় করেছিলেন। ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগ সরকার এ জায়গায় ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয় এবং সেখানে অবকাঠামোগত কিছু উন্নতি ঘটাতেও দেখা যায়। বাংলা ভূখন্ডের ইতিহাসে একজন রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) অনুষ্ঠানের উদ্বোধন প্রথম বঙ্গবন্ধুই করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম দেশের সত্যপন্থী আলেম সমাজ কর্তৃক ‘সিরাত মজলিশ’ গঠন করে প্রথম পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) মাহফিল উদযাপনের এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে মদ, জুয়া, লটারি এসব ইসলামবিরোধী কাজ আইনগতভাবে বৈধ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের সরকার দেশ পরিচালনার সময় আইন পাস করে মদ, জুয়া, লটারি প্রভৃতি ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এ ছাড়া ধর্মীয় দিবস শবেবরাত, শবেকদর ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণাও বঙ্গবন্ধু সরকারই করেছিল।
বঙ্গবন্ধু জানতেন, মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ইসলামের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সরকারি বিবৃতির মাধ্যমে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপনের পর আরবদের শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ২৮ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল প্রেরণ করেন। পাঁচ হাজার সদস্যের স্বেচ্ছাসেবী মুক্তিযোদ্ধা প্রেরণ করেন, মিসরের জন্য এক লাখ পাউন্ড চা প্রেরণ করেন। আরবদের এসব সহযোগিতা প্রদান করে বঙ্গবন্ধু খাঁটি মুসলমানের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক সাফল্য বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে, সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই উদার, মহৎ, আন্তর্জাতিক দূরদর্শী দেশনায়ক। তিনি ইসলামী মূল্যবোধ প্রসারে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আরব বিশ্বের বহু দেশও সফর করেছিলেন। ইসলামের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে গোটা দুনিয়া, বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে মূলত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, মেধা এবং সীমাহীন কর্মপ্রচেষ্টা ও অক্লান্ত মেহনতের কারণেই। এমনকি তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত এবং রেখে যাওয়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও আমাদের হেদায়েতের পথ প্রদর্শন ও কোরআন-হাদিসের জ্ঞানলাভে সহায়তা করছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।