Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন্ড অপব্যবহারে রাজস্বহানি

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

কড়া নজরদারিতেও থামছে না বন্ড সুবিধার অপব্যবহার। বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি পণ্য চলে যাচ্ছে খোলা বাজারে। এতে সরকার বছরে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। বন্ড সুবিধার অপব্যহারের মাধ্যমে চোরাচালানে জড়িত মাফিয়া চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের শিল্প খাত।

বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত কাপড়, কাগজ, প্লাস্টিক দানাসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করছে তারা। এভাবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এ মাফিয়াচক্র। এই চক্রটি ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের সাথেও জড়িত।

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের এক তথ্যে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামের একশর বেশি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় ৭৯০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে উৎপাদনে কাজে না লাগিয়ে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। সুযোগের এই অপব্যবহারের কারণে সরকার প্রায় ৩৭১ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। চট্টগ্রামের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ৩০০টি বিভাগীয় মামলা করেছে। এরমধ্যে ৫০টি মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে এবং ২৪০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তবে বাস্তবে খোলাবাজারে পণ্যবিক্রি ও শুল্ক ফাঁকির পরিমাণ আরও অন্তত দশগুণ বেশি।

গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের দেওয়া একটি তথ্যে দেখা যায়- গত অর্থ বছরে (২০১৮-১৯) বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের অবৈধ অপরসারণের প্রায় ৬০টি ঘটনা ধরা পড়ে। এরমধ্যে ৩২টি ঘটনায় রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার ৯৩৯ টাকা। এসব রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা চলছে বলে জানান বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য খোলা বাজারে বিক্রিকালে ৩২টি চালান আটক হয়।

এসব চালানের মাধ্যমে ১০৪ কোটি ৩৮ লাখ ২৬ হাজার ৮১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ে। সম্প্রতি কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের ৫৯ কোটি ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ টাকার কাঁচামাল বিক্রিকালে ধরা পড়ে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ৫৬ কোটি ৩১ লাখ ৩০ হাজার ১১৪ টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা হয়। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান ১৭ কোটি ৫১ লাখ ৮৫ হাজার ৬২৮ টাকার পণ্য বিক্রির মাধ্যমে ১২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৯০ টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে।

দেশে কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০০ সালে। চট্টগ্রামে আলাদা বন্ড কমিশনারেটের কার্যক্রম শুরু হয় বিগত ২০১১ সাল থেকে। এ পর্যন্ত কয়েকশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মামলা হয়েছে। এরমধ্যে দেশি তৈরী পেশাক কারখানা ও জাহাজ নির্মাণ কারখানাও রয়েছে। আবার এ অঞ্চলের চারটি ইপিজেডের অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানও এমন অপকর্মের সাথে জড়িত রয়েছে।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায়ই এ সুবিধার অপব্যবহার করছে। দফায় দফায় অভিযানে তাদের গুদাম ও গাড়িবহর থেকে জব্দ করা হয়েছে শত শত কোটি টাকার পণ্য। বিভিন্ন সময় জাল-জালিয়াতি ও বন্ড লুটপাটের অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। এসব কারণে ওরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। রাজস্ব বিভাগের কঠোর নির্দেশনা, ধারাবাহিক অভিযান, মালামাল জব্দ-কোনো কিছুতেই বন্ড মাফিয়াদের দমানো যাচ্ছে না। রফতানিমুখী শিল্পকারখানা বিদেশে পণ্য রফতানি করতে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে। আমাদানিকৃত পুরো কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার করে সে পণ্য বিদেশে রফতানির শর্তে তাদের বন্ড সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান শুল্কম্ক্তু সুবিধায় আনা এসব পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে করে আমদানিকারকরা দিনে দিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন।

বন্ড কশিনারেটের একজন কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে সরাসরি মার্কেটে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার নিজেদের গুদাম থেকে সুযোগ বুঝে পণ্য সরিয়ে নেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া বন্ড কমিশনারেটের পক্ষে এসব চালান ধরা সম্ভব হয় না। তাছাড়া আমদানিকারকদের কেউ কেউ এত বেশি প্রভাবশালী যে তাদের গুদামে তল্লাশিও করা যায় না। ফলে বেশিরভাগ ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। মাঝে মধ্যে কিছু চালান ধরা পড়ে, আর তখন বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হয়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, বন্ড সুুবিধার অপব্যহার করে কয়েক লাখ কোটি টাকার শুল্কফাঁকি দেওয়ার ঘটনা সবার জানা। অথচ সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার কিছু লোককে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করা গেলে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হতো মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা গেলে প্রবৃদ্ধি আরও অনেক বাড়ত। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে চট্টগ্রামের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান দাবি করেন কঠোর নজরদারির কারণে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার কমে আসছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ