Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেডের চেয়ে ডেঙ্গু রোগী বেশি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৯, ১২:০০ এএম

রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গেল কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে দশ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় তখন রেকর্ড হয়েছিল। ২০১৯ সালে সাত মাসেরও কম সময়েই ডেঙ্গু আক্রান্তে গেল বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হতে চলছে। রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীর ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। চলতি বছরে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৬ জন। তাদের মধ্যে এই জুলাই মাসেই সর্বোচ্চসংখ্যক ৭ হাজার ১১২ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
হাসপাতালগুলোতে বলতে গেলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ কোন জায়গায়ই বেড খালি নেই। সরকারি হাসপাতালে বারান্দায় অতিরিক্ত বেড দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে। অনেক রোগীকে ফেরত দেয়া হচ্ছে- বলছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডীন ডা. এ বি এম আব্দুল্লরাহ। তিনি জানান, এ মৌসুমে কয়েক হাজার ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। এ বছর তো অনেক রোগী দেখলাম, সেই জানুয়ারি থেকে শুরু করেছি। মে জুন থেকে তো ডেইলি প্রচুর রোগী দেখছি। প্রতিদিনই বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা ভিড় করছেন, অনেকেই সিটের অভাবে ভর্তি হতে পারছেন না বলে জানান তিনি। যেখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ার কথা না যেমন নিউরোলজি ওয়ার্ড, সিসিইউ ইত্যাদিতেও বেড দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে যে হারে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে এ মাস শেষ হওয়ার আগেই গত বছরের আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড ভেঙে যাবে। এদিকে ৯ হাজারেরও বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।
হাসপাতালের বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর পুরন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসাপাতালে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এখানকার চিকিৎসকদের অভিযোগ, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সে পরিমাণে ডাক্তার বা নার্স নেই। এজন্য তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগী বেশি হওয়ায় তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা, চিকিৎসকের চেম্বার এবং লিফটের সামনে থেকে শুরু করে বাথরুমের দরজা পর্যন্ত সর্বত্র রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শত কষ্ট মুখ বুঝে সহ্য করে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীরা। এ বিষয়ে কথা হয় মিটফোর্ড হাসাপাতালের চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী আলতাফ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, দুইদিন আগে মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ১-৩-৫-৭ ইউনিটে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়ার সময় কোনো বেড পাইনি। এজন্য ফ্লোরে বেড পেতে চিকিৎসা নিচ্ছি। যেভাবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে তাতে কারও কিছুই করার নেই। সব হাসপাতালে একই অবস্থা। হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগী বেশি।
একই বিভাগের সিনিয়র নার্স সাথী হালদার বলেন, এই ইউনিটে ডেঙ্গু আক্রান্তসহ ১৭২ জন রোগী রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ৪৪ জন ডঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আগের রোগীসহ নতুন রোগী যোগ হওয়ায় আমরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। মিটফোর্ড হাসাপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে এখন ১৯৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাছাড়াও প্রতিদিন ৬৫/৭০ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আর প্রতিদিন চিকিৎসা শেষে ৩০/৪০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল ছাড়ছেন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বেসরকারি আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তানিয়া সুলতানা (২৮) নামে আরও এক নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। তানিয়া সুলতানার স্বামী ব্যবসায়ী আমিনুল বাহার হিমন গতকাল শুক্রবার জানান, তানিয়া সুলতানা গত ২২ জুলাই থেকে জ্বরে ভুগছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ২৪ জুলাই তাকে রাজধানীর মগবাজারে কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গতকাল তাকে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার আব্দুল কাহার আকন্দের অধীনে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রাত ১০টায় তার মৃত্যু হয়।
রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ আইসিডিডিআরবিতে সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা শুরু হয়। গতকাল দুপুর ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, ৩৭৯ নম্বর সিরিয়াল চলছে। অর্থাৎ সকালে চার ঘণ্টায় প্রায় ৪০০ রোগী নানা পরীক্ষা করিয়েছেন। আর এদের মধ্যে বেশিরভাগই আসেন ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে। আইসিডিডিআরবির পরীক্ষা কক্ষে কয়েকজন নার্সের ভাষ্য অনুযায়ী, এখানে অনেক রোগী পরীক্ষা করাতে আসেন। তবে গত কয়েক দিনে রোগীর পরিমাণ বেড়ে গেছে।
গত কয়েক দিনে ঢাকায় ব্যাপক হারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিতে ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুরা। আইসিডিডিআরবি ছাড়াও আরও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, গত কয়েকদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ৬৯৭ জন। এদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি ১৫০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ১২ হাসপাতাল এবং বেসরকারি ১৭টি হাসপাতালে গতকাল ২ হাজার ৫৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। আর এ মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৪২১। এ বছর এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৮ হাজার ৫৬৫ জন।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সা¤প্রতিক হিসাব বলছে, হাসপাতালভিত্তিক সরকারি হিসাবে মাত্র ২ শতাংশ রোগীর তথ্য পায় সরকার। আবার অনেকে ডেঙ্গু শনাক্তের পরও বহির্বিভাগ থেকে চলে যাচ্ছে বাসায়। যারা ভর্তি হতে আসছে, তাদের সামাল দিতেই হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হলেও ইতোমধ্যে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৬ হাজার ৯২৬ জন। বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালে ২ হাজার ৩২২ জন ভর্তি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য হালনাগাদ চিকিৎসা গাইডলাইন প্রণয়নের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাসহ সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার সংখ্যা কমানোর জন্য বিদেশ থেকে একধরনের মশা আমদানি করার চিন্তা-ভাবনা চলছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডেঙ্গু


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ