Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

বন্যার ধাক্কা আগস্টেও

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০০ এএম

দেশে আবারও বন্যার ধাক্কা আসার ঝুঁকি রয়েছে আগস্ট মাসে। আগস্টের শেষ ভাগে অর্থাৎ শ্রাবণের শেষে ও ভাদ্র মাসের গোড়ার দিকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার এ ঝুঁকি থাকবে। যদিও তা নির্ভর করছে বর্ষার মৌসুমী বায়ুর জোর তথা বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতির ওপর। গতকাল (বুধবার) পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আবহাওয়া বিভাগ থেকে প্রাপ্ত আবহাওয়া পূর্বাভাসের ভিত্তিতে একথা জানায়। চলমান বন্যা পরিস্থিতি এবং আগস্ট মাসে বন্যা পূর্বাভাস সম্পর্কে এতে পাউবো’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সামগ্রিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির নতুন করে অবনতির আশঙ্কা নেই। এ মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ বন্যা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসতে পারে। আগস্ট মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশে বড় কোনো বন্যার আশঙ্কা নেই।

এদিকে বন্যা পারিস্থিতি ও নদ-নদী প্রবাহের গতকাল সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পানি কোথাও নামছে। আবার কোথাও বাড়ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের উজান থেকে ঢল নেমে আসার কারণে ফের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা-ধরলা-ঘাগট নদীসমূহের। তাছাড়া বিপদসীমার ওপর আরও পানি বাড়ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে।

উত্তর, মধ্য ও উত্তর-পূর্বের বন্যাকবলিত জেলাসমূহে লাখ লাভ বন্যার্ত মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা ও ওষুধের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অনাহারে অর্ধাহারে বন্যার্তরা অসহায়ভাবে দিন গুজরান করছে। অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র, মাঠে-ঘাটে, খোলা জায়গায় কিংবা বাঁধের ওপর দিনাতিপাত করছে তারা। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগব্যাধি। শিশু-বৃদ্ধদের দূর্গতি অবর্ণনীয়। অথচ ছিটেফোঁটা ত্রাণ সাহায্য মিলছে না।

পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী অববাহিকায় বাংলাদেশ ও ভারতের উজানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ শুরু হয়। এতে করে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বন্যা কবলিত হয়। তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ ও উজানে বৃষ্টিপাতের মাত্রা হ্রাসে নদ-নদীসমূহে পানি হ্রাস পেতে শুরু করে। ক্রমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। বর্তমানে প্রধান নদীগুলোর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে।

তবে চলমান বন্যার মাত্রা স্থানভেদে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এরফলে প্রধান নদীগুলোর পানি হ্রাস পাওয়া সত্তে¡ও অনেক স্থানে বিপদসীমার ওপরে রয়েছে। এছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে মৌসুমী বায়ু সক্রিয়। এরফলে পানির সমতল সম্পূর্ণ বিপদসীমার নিচে আসার দিনক্ষণ কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। এ মাসের শেষ নাগাদ বন্যা পুরোপুরি স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসতে পারে।

পাউবো গতকাল জানায়, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, ঘাগট এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল ও মেঘালয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি হ্রাস এবং যমুনা স্থিতিশীল থাকতে পারে। তিস্তা, ধরলাসহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলোর পানি দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যার কিছুটা অবনতি হতে পারে।

গতকাল ২৪ ঘণ্টায় দেশের নদ-নদীসমূহের ৯৩টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৪৬টিতে পানি বৃদ্ধি ও ৪৩টিতে হ্রাস পায়। অপরিবর্তিত থাকে ৪টি পয়েন্টে। ১০টি নদী ১৮ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর ছিল।
আগামী ৪৮ ঘণ্টায় তিস্তা ও ধরলা নদীসমূহের পানির সমতল দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর জনপদের ধরলা নদী কুড়িগ্রামে গতকাল বিকেল পর্যন্ত পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ২০ সে.মি. ওপরে প্রবাহিত হয়। তিস্তা নদী ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২৮ ও ২৪ সে.মি. নিচে। সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়া অন্যান্য প্রধান নদ-নদীর পানির সমতল হ্রাস পায়।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল হ্রাস অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

নদ-নদীর বিপদসীমা পরিস্থিতি
পাউবো প্রধান নদ-নদীগুলোর প্রবাহ সম্পর্কে জানায়, গতকাল উত্তরবঙ্গে তিস্তা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তা কাউনিয়া পয়েন্টে মাত্র ২২ সেমি নিচে। ভারত উজানে গজলডোবা বাঁধের গেটগুলো খুলে দেয়ার কারণে তিস্তা নদী অঞ্চলে বন্যার অবনতি ঘটেছে।
গাইবান্ধায় ঘাগট নদীর পানি বিপদসীমার ১৮ সেমি ঊর্ধ্বে। কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৪৬ সেমি ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে ভারতের উজানে অতিবৃষ্টির ঢলে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের সবকটি পয়েন্টে। ব্রহ্মপুত্র নদ চিলমারী পয়েন্টে ২৬ সেমি ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ছুঁই ছুঁই অবস্থানে রয়েছে। যমুনা নদের পানি ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ১১ থেকে ৩৮ সেমি ওপর রয়েছে এবং বৃদ্ধির দিকে। বানের পানির নামতে থাকায় ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর পানি কোথাও বেড়েছে। তবে কোথাও কমতির দিকে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর আরও বেড়ে গেছে। গতকাল উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং এর সংলগ্ন ভাটিতে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে ভারী বর্ষণ হয়েছে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ধরলা ও তিস্তা অববাহিকার ৭০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে ঘর-বাড়ি ও রাস্তাঘাট। কুড়িগ্রাম-সদরের বাংটুর ঘাট থেকে ফুলবাড়ী বাঁধের উপর পাকা রাস্তাটি বাংলাবাজার নামক স্থানে ভাঙনের মুখে পড়েছে। বাঁধটি ভাঙলে ৪০-৫০টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ পানিবন্দী মানুষ চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। তাদের গবাদি পশুগুলিও খাদ্য সংকটে পড়েছ্ েঅনেকে বাধ্য হয়ে পানির দামে গবাদি পশু বিক্রি করে দিচ্ছে।

এদিকে পানির তোড়ে ভেঙে গেছে নাগেশ^রী পৌর এলাকার সাঞ্জুয়ার ভিটা সড়ক। তিস্তার ভাঙনে উলিপুর উপজেলার নাগরাকুড়া টি বাঁধের ৫০ ফুট এলাকা পানির প্রবল চাপে ধসে গেছে। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, বন্যায় জেলার ৬০টি ইউনিয়নে ৮৯৪টি গ্রামের ২লাখ ৩৮হাজার ৬৭২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ। বন্যায় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছে এক হাজার ৮৫৩টি পরিবার। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৩৩ হাজার হেক্টর।

নীলফামারী : তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে আবারও বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
শিবচর (মাদারীপুর) : শিবচরে পদ্মা নদীর পানি ও আড়িয়াল খা নদে. পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করায় নদী ভাঙনের ব্যাপকতা অব্যাহত রয়েছে। সরকারি হিসেবে নদী ভাঙনে ৪ শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পানিবন্দী রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার পরিবার। চরাঞ্চলের ২০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে । চরাঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার পানি বন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদিকে দূর্গতদের জন্য ত্রান তৎপরতা জোড়ালো করা হয়েছে।

পাবনা : পাবনায় পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিপদসীমা অতিক্রম না করলেও যে কোন সময় অতিক্রম করতে পারে। পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চাল্লে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। অপরদিকে, নদী ভাঙন প্রবল হয়ে উঠেছে। জেলার সুজানগর উপজেলায় এই ভাঙনের তীব্রতা এখন বেশী। প্রতি মুহুর্তে পদ্মা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে , জমি, বাড়ী-ঘর। নিম্নাঞ্চল পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
গফরগাঁও : বুধবার দিনভর গফরগাঁও উপজেলায় ব্রক্ষপুত্র নদীতে প্রতিনিয়তই বন্যায় পানি বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন ফসল ক্ষতিক্ষস্ত হচ্ছে । নদীর মাঝ খানে উচু এলাকায় ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে । ফলে ন্মিমশ্রেণীর লোকজনের সংসারে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে । ফসল তলিয়ে যাওয়ার ফলে শাকসবজির দাম হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ