Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছয় জেলায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার ১৬ জন

আসক’র উদ্বেগ : বাড্ডার ঘটনায় ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ছেলে ধরা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। গুজব রটিয়ে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। গতকাল রোববার ছয় জেলায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে ১৬ জন গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। গত শনিবার রাজধানীর উত্তর বাড্ডা, কেরাণীগঞ্জের কলাতিয়া, গাজীপুর, সাভারের তেতুলঝোড়া, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নারীসহ নিহত হয়েছে ছয়জন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। এদিকে, গণপিটুনিকে ফৌজদারী অপরাধ উল্লেখ করে, আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সতর্ক করেছে পুলিশ সদরদপ্তর।
এছাড়া ছেলেধরা সন্দেহে দেশের বিভিন্ন জেলায় গণপিটুনিতে নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল রোববার আসকের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগের কথা জানানো হয়। গত শনিবারের গণপিটুনির ঘটনায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি আসক’র উদ্বেগ
স¤প্রতি ছেলেধরা সন্দেহে দেশের বিভিন্ন জেলায় গণপিটুনিতে ৫জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল রোববার আসকের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগের কথা জানানো হয়। দ্রুততার সঙ্গে এসব ঘটনার তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে আসক’র পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামীতে এ ধরনের প্রবণতা রোধে দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, পদ্মাসেতু নির্মাণে ‘মানুষের মাথা লাগছে’ বলে ছড়িয়ে দেওয়া গুজবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এ প্রবণতায় আসক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আসক মনে করে, হঠাৎ করে মারাত্মক আকার ধারণ করা এসব ঘটনায় জনমনে আতংক, নাগরিক নিরাপত্তায় বিঘ্নন ও সর্বোপরি দেশে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে আসক’র পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ‘ইতোমধ্যে পুলিশ সদরদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গুজবের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিবৃতিতে গণপিটুনি ফৌজদারি অপরাধ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি বিচেনায় সতর্কতা বজায় রাখবে এবং দ্রুততার সঙ্গে সংঘঠিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করবে।

টাঙ্গাইলে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি
টাঙ্গাইলে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজন গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, গতকাল সকালে সদর উপজেলার কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। তার নাম আকাশ (৪২)। বাড়ি গাজীপুর। দুপুরের দিকে কালিহাতী উপজেলার সয়াপালিমা গ্রামে গণপিটুনির শিকার হন অজ্ঞাত এক যুবক। তাকে পুলিশ উদ্ধার করে কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। এ ছাড়া গত শনিবার রাত ১১টার দিকে শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড় এলাকা থেকে গণপিটুনির শিকার একজনকে পুলিশ উদ্ধার করে। টাঙ্গাইল সদর থানার পুলিশ (পরিদর্শক) মো. সালাউদ্দিন বলেন, কাউকে অপরাধী বলে সন্দেহ হলে পিটুনি না দিয়ে পুলিশে দেওয়ার জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে।

কুমিল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে নারীসহ ৩জনকে গণপিটুনি
ছেলেধরা সন্দেহে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার দুতিয়ার দিঘির পাড় এলাকায় এক নারীসহ তিনজনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। তারা হলেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের আবদুস সালাম (৭০), তার স্ত্রী রত্মা বেগম (৪০) ও একই গ্রামের রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন (৩০)।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাম ও রত্মা দম্পতি রিকশা নিয়ে আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলি ইউনিয়নের দুতিয়ার দিঘি এলাকায় যান। একটি বাড়ির সামনে গিয়ে স্কুলগামী এক শিশুকে কথা আছে বলে ডাক দেন। তখন আশপাশের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে চিৎকার করেন। এই সময়ে তারা রিকশা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে জনতা তাদের ধরে পিটুনি দেন। পরে পুলিশে খবর দিয়ে তাদের সোপর্দ করা হয়। কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

চিরিরবন্দরে গণপিটুনী দিয়ে পুলিশে সোর্পদ
মোরশেদ উল আলম, চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, চিরিরবন্দরে ছেলে ধরা সন্দেহে মো. মিরু মিয়া (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনী দিয়ে থানা পুলিশে সোর্পদ করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় উপজেলার ভিয়াইল ইউনিয়নের নানিয়াটিকর গ্রামের মুহুরীপাড়ায় ঘটেছে। আটক মিরু মিয়া কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর আব্দুল হাইয়ের ছেলে।

এলাকাবাসি সূত্রে জানা গেছে, ওই সময় মিরু মিয়া একটি পুরাতন চটের বস্তা নিয়ে এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। এতে এলাকার লোকজনের ছেলেধরা সন্দেহ হলে তাকে আটক করে গণপিটুনী দিতে থাকে। এসময় স্থানীয় ইউপি সদস্য মাবিয়া বেগম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে থানা পুলিশে খবর দেয়। থানা পুলিশের এস আই আব্দুল জলিল ঘটনাস্থলে এসে মিরু মিয়াকে থানায় নিয়ে আসেন।
ওসি মো. হারেসুল ইসলাম জানান, আটককৃত মিরু একজন অর্ধ-পাগল ব্যক্তি। তবে এলাকাবাসিকে ছেলে ধরা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। ছেলেধরা সন্দেহে পাগলদেরকে মারপিট না করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

লালমনিরহাট
ছেলেধরা সন্দেহে গত শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লালমনিরহাট শহরের খোঁচাবাড়ি মৌজার ডাইলপট্টি এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে (৪৫) আটক করে এলাকাবাসী পিটুনি দেয়। সংবাদ পেয়ে ওই নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে লালমনিরহাট সদর থানার এসআই জিল্লুুর রহমান আহত হন। বর্তমানে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। লালমনিরহাটের এসপি এস এম রশিদুল হক বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে বা আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটালে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নাটোরে ছেলে ধরা সন্দেহে যুবককে গণপিটুনি

নাটোর জেলা সংবাদদাতা জানান, নাটোরে ছেলে ধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেয়ার সময় উদ্ধার করেছে পুলিশ। নাটোর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিন জানান, দুপুরে শহরের হাফরাস্তা তালতলা এলাকায় এক যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে এলাকাবাসী তাকে ধরে গণপিটুনি শুরু করে। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ জানায় উদ্ধারকৃত ব্যক্তি একজন মানসিক প্রতিবন্ধি। এসব ঘটনায় আইন নিজের হাতে না নিয়ে পুলিশের সহায়তা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন নাটোর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিন। উদ্ধারকৃত যুবকের পরিচয় জানতে পারেনি পুলিশ।

সান্তাহারে গণপিটুনি
আদমদীঘি (বগুড়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, বগুড়ার সান্তাহারে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ছেলে ধরা সন্দেহে আজমল হোসেন (৪৫) নামে এক ব্যাক্তিকে স্থানীয় জনতা আটক করে গণপিটুনি দেয়। পরে স্থানীয় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে টাউন পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। সে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের আবাদুল খালেকের ছেলে।
শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, সে মানসিক রুগি ১০ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর পরিবারের লোকজন তাকে খোজাখুজি করছিল। এব্যাপারে সান্তাহার টাউন পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো ঃ আনিসুর রহমান বলেন, তার পরিবারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ চলছে।

নওগাঁয়ে গণপিটুনিতে শিকার ৬জন
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার মান্দা উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে গতকাল ছেলেধরা সন্দেহে ছয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনির শিকার ছয় ব্যক্তি হলেন নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন, তসলিম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আবদুল মজিদ আকন্দ ও আনিছুর রহমান এবং সদর উপজেলার ফারতপুর গ্রামের রেজাউল করিম।

স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৮টার দিকে এ ছয়জন উপজেলার বুড়িদহ গ্রামের রণজিৎ কুমার চৌধুরীর পুকুরে চুক্তিভিত্তিক মাছ ধরতে যান। পুকুরের মালিকের সঙ্গে তাদের চুক্তি ছিল যে তারা শুধু ছোট মাছ ধরবেন। কিন্তু তারা কয়েকটি বড় মাছও ধরে ফেলেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে পুকুরমালিকের কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে পুকুরের মালিক ও গ্রামের লোকজন ছয় জেলেকে মারধর করতে শুরু করেন। তারা নিজেদের বাচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় গ্রামের লোকজন ছেলেধরা বলে চিৎকার করতে শুরু করলে আরও লোকজন ছুটে গিয়ে প্রথমে সাদ্দাম হোসেন নামের এক জেলেকে আটক করেন। ছেলেধরা পালিয়ে গেছে খবর রটে গেলে পাশের খুদিয়াডাঙ্গা গ্রামের লোকজন অন্য পাঁচজন জেলেকে আটক করে পিটুনি দেয়।

মান্দা থানার ওসি মোজাফফর হোসেন বলেন, পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্ব›েদ্বর জেরে গ্রামবাসী ছেলেধরা গুজব রটিয়ে ছয় ব্যক্তিকে মারধর করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তারা এখন থানা হেফাজতে আছেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

৫০০জনের বিরুদ্ধে মামলা
রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তসলিমা বেগম রেনু (৪০) নামের এক নারী নিহত হওয়ার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে বাড্ডা থানায় গণপিটুনিতে নিহত ওই নারীর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন এই মামলা করেন।
এসআই মাসুদ আলম বলেন, মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে অতর্কিতভাবে ওই নারীকে স্কুলের অভিভাবক, উৎসুক জনতাসহ আরও অনেকে বেধড়ক পিটুন দেয়। নিহতের নাম তসলিমা বেগম রেনু। তার ১১ বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। বছর দুয়েক আগে তার স্বামী তসলিম উদ্দিনের সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এরপর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে মহাখালী ওয়ারলেস এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তিনি।
নাসির উদ্দিন বলেন, রেনু মানসিক রোগে ভুগছিলেন। মানসিক অসুস্থতার কারণে তার আচরণ অস্বাভাবিক ছিল। এজন্য স্কুলের অনেকেই তাকে ছেলেধরা হিসেবে সন্দেহ করছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ