পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
যে মঞ্চে বসে একে অপরের জীবন সঙ্গী হয়েছিলেন ভাগ্যের নির্মমতায় সেই মঞ্চেই লাশ হয়ে ফিরে এলেন সুমাইয়া। বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের হাসি আনন্দে মুখর আয়োজন নিষ্ঠুর বিষাদে পরিণত হবে এমনটা কারো জানা ছিল না। তবে হঠাৎ একটি খবরে পুরো বাড়ির আনন্দ উৎসবের রং পাল্টে রূপ নেয় কান্নায়। একমাত্র ছেলের বউকে ঘরে তুলে সংসার আলোকিত করার ইচ্ছে পূরণ হলো না বাবা আলতাফ হোসেনের। দুঃখ নামক সাগরের ভয়ংকর ঢেউ এসে সব ভাসিয়ে নেবে জানা ছিল না রাজনের মায়ের। আর সুমাইয়ার মা জানতেন না এটিই ছিল মেয়ের শেষ বিদায়। সাজানো বাসর ঘর, হাতে মেহেদীর রং না শুকাতেই শেষ হয়ে গেল রাজন ও সুমাইয়া দম্পতির জীবন। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবার মাত্র আড়াই ঘণ্টা পরেই ট্রেনের ধাক্কায় নিভে গেল তাদের জীবন প্রদীপ। গড়ে উঠার আগেই ভেঙে গেলো দুটি জীবনের নতুন পরিবার গড়ার পথচলা।
গতকাল মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে নিহত বর রাজনকে এক নজর দেখার জন্য এবং পরিবারকে শান্তনা দিতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারও মানুষ ভিড় জমায়। রাজনের বাবা আলতাফ হোসেন উঠোনে মাঝে সন্তানের লাশ সামনে নিয়ে নির্বাক। রাজনের মা থেকে থেকে চিৎকার দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছেন। মা বারবার কফিনে ঝাপ দিয়ে ছেলের মুখে হাত বুলানোর চেষ্টা করলে পাড়া-পড়শিরা তাকে সামলে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। সুমাইয়ার লাশের পাশে বসে তার মা হাফিজা খাতুন আহাজারি করছিলেন বার বার। আহাজারি করছিলেন তার স্বজনেরাও। হাফিজা বলছিলেন, কত দুর্ভাগা আমার মেয়ে। বিয়ের পর পরই কপাল পুড়ল তার। সুমাইয়ার লাশ ওই বাড়িতে এসে পৌঁছলে এসময় পরিবারের স্বজনরে কান্নায় সেখানকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এই ঘটনায় বর রাজনের ফুফা ও ফুফাতো ভাই, বড় বোন জামাই, বন্ধু-বান্ধবসহ আত্মীয় স্বজন মারা গেছেন।
এই ঘটনায় মারা যায় পিতা পুত্র সামাদ ও সাকিল। সামাদ বর রাজনের ফুফা আর সাকিল ফুফাতো ভাই। সিরাজগঞ্জ সদরের রামগাঁতি গ্রামে নিহত পিতা-পুত্রের বাড়িতে আশপাশের হাজারো মানুষ এসে ভিড় জমায় বাদ ফজর থেকেই। স্বামী ও সন্তানকে হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন সাকিলের মা। সাকিলের মায়ের চোখের পানি দেখে উপস্থিত লোকজন অঝর নয়নে কেঁদেছেন এবং বলছেন এমন মৃত্যু যেন আর কাউকে দেখতে না হয়। বর রাজনের মত সুমাইয়ার বড় বোন জামাই শরীফও মারা গেছে। শরীফের বাড়ি শহরের দিয়ারধানগড়াতে। সে বাড়িতেও ভোরে তিল ধারণের ঠাই নেই। সবাই এসেছে শরীফকে এক নজর দেখতে। শরীফের শিশু কন্যা বাবার বুকে মাথা রেখে প্রলাপ বকছে কিন্তু বাবা সাড়া দিচ্ছে না। রাজনের কয়েকজন বন্ধু মারা গেছে এই ঘটনায়। তাদের অন্যান্য বন্ধুরা রাতে ছুটে এসেছে সদর হাসপাতালে। সারা রাত দৌড়াদৌড়ির অন্ত ছিলনা লাশ খোঁজা ও শনাক্ত করণে। সকালে এসেছে তারা দাফন কার্য সম্পন্ন করতে। এসে বন্ধু বন্ধকে হারিয়ে হতবিহবল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিহতরা পরস্পর আত্মীয় এবং তাদের বাড়িও আশপাশ এলাকার হওয়ায় মানুষের আবেগটাও ছিল অন্য রকম।
গত সোমবার সন্ধ্যায় উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেল স্টেশনের উত্তর পূর্ব পাশে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এ ট্রেনের সঙ্গে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় কনে সুমাইয়া ও বর রাজনসহ ১১ জন মারা যান। নিহতরা হলো সদর উপজেলার কালিয়া কান্দাপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে (বর) রাজন সেখ, উল্লাপাড়া উপজেলার মৃত গফুর সেখের মেয়ে সুমাইয়া খাতুন (কনে) সুমাইয়ার বোন জামাই সিরাজগঞ্জ শহরের দিয়ারধানগড়া গ্রামের শরীফ, সয়াধানগড়া গ্রামের সুরত আলীর ছেলে আহাদ আলী, রায়পুর গ্রামের মুছার ছেলে এবং রাজনের ভগ্নিপতি সুমন, রাজনের ফুফা রামগাতির সামাদ ও ফুফাতো ভাই সামাদের ছেলে সাকিল, আত্বীয় কামারখন্দের কৃঞ্চদিয়ার গ্রামের আলমের ছেলে খোকন, চুনিয়াহাটি গ্রামের মহির উদ্দিনের ছেলে ভাষা সেখ, কান্দাপাড়া গ্রামের শামীমের ছেলে বায়েজীদ ওরফে আলীক ও জামতৈল গ্রামের মাইক্রো চালক স্বাধীন। এছাড়াও গুরুতর আহত হয়েছেন রাজনের আপন ছোট বোন স্বর্ণা খাতুনের স্বামী সুমন (৩০)। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার জানাজা শেষে দুপুরে শহরতলীর কান্দাপাড়ায় রাজন ও চর ঘাটিনা কবরস্থানে সুমাইয়া ও তার স্বজনদের লাশ দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় উভয় পরিবার ও এলাকার মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে শোকের কালো ছায়া। সবাই নির্বাক আর হতবিহŸল। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেন বাড়ি গেলে সদ্য বিবাহিত বর রাজন শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নিস্তব্ধ শোকাবহ পরিবেশ। চোখের পানি ঠেকাতে পারছেন না দূর-দুরান্ত থেকে আসা শত শত নারী পুরুষ। শুধু কান্দাপাড়া নয় আশপাশের গ্রামগুলো থেকেও শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মাননুষ। ওই বাড়িতে এসে এমন শোকাবহ পরিবেশ দেখে অজান্তেই চোখের অশ্রæ গড়িয়ে পড়ছে অনেকের। সেখানে কথা হয় চুনিয়াহাটি থেকে আসা রাজিয়া খাতুন, কালিয়ার আব্দুল শেখ, মাসুমপুর মহল্লার রাজু, রায়পুরের হাসিনা বেগমের সঙ্গে। তারা বলেন, নাটক সিনেমা ছাড়া এমন দৃশ্য আগে কখন দেখি নাই। আল্লাহ এমন শোক যেন আর কাউকে না দেন। প্রতিবেশীরা বলেন, আলতাফ হোসেন একজন গরুর ব্যবসায়ী। তার ছেলে রাজন টুইষ্টিং মিলের শ্রমিক। বড় মেয়ে স্বর্ণা খাতুনের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে রুপা লেখাপড়া করছে। বাপ-ছেলে মিলে সংসারটা ভালোই চালাচ্ছিলেন। সোমবার রাজনের বিয়ে ছিল উল্লাপাড়া উপজেলার এনায়েতপুর গুচ্ছগ্রামের মৃত গফুর শেখের মেয়ে সুমাইয়ার সঙ্গে। বিয়ের জন্য দুপুরে দুটি মাইক্রোবাসে প্রায় ৩০ জন বরযাত্রী নিয়ে যান তারা। উৎসবমুখর পরিবেশে সেখানে বিয়েও হয়ে যায়। বর-কনে কবুল পাঠ করে একে অপরকে জীবনসঙ্গী করে নিলেন। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে স্বপ্নগুলো পড়ে রইলো স্বপ্নের জায়গায়। রইলো না স্বপ্ন বোনার মানুষগুলো। মঙ্গলবার দুপুরে শহরতলীর কান্দাপাড়া কবরস্থানে নিহত রাজনের বাবা সাংবাদিকদের বলেন, আর যেন কোন পরিবার অরক্ষিত রেল ক্রসিং এর কারণে প্রাণ না হারায়। কোন পিতা যেন তার একমাত্র সন্তাকে হারিয়ে নিঃস্ব না হয়।
সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন মজুমদার জানান, বিধি মোতাবেক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের নিকট লাশ গুলো হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় রেল পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় পাকশী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার করে টাকা এবং আহতদের প্রতিজনকে ১০ হাজার করে টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।