Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছুটছে বানভাসি মানুষ

বন্যাকবলিত ১৬ জেলা : ১৫ নদ-নদীর ২৫ পয়েন্ট বিপদসীমা অতিক্রম : ৭৩ স্থানে নদীভাঙন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

উজানে অতিবৃষ্টি ও ভারতের ঢল অব্যাহত রয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে আসাম। বন্যার্তদের উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণে সেখানে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ উত্তর-পূর্ব, বিহার রাজ্যসহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের অনেক অঞ্চল এবং নেপালে অতিবর্ষণ ও ঢল-বানের তোড় বেড়েই চলেছে। আর ভাটিতে ভাসছে বাংলাদেশের ব্যাপক অঞ্চল।

এ মুহূর্তে বন্যার্ত লাখো মানুষের দুঃখ-কষ্ট অবর্ণনীয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, স্থানীয় যোগাযোগ, পরিবহনসহ জীবনযাত্রা প্রায় অচল। বিপর্যয় ঘটছে ফল-ফসল, ক্ষেত-খামারসহ গ্রামীণ অর্থনীতির। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ মহল এবং পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রগুলো আশঙ্কা করছে, এ বন্যার গ্রাস অন্তত দশদিন অনধিক দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি মধ্যমেয়াদি বন্যা।

দেশজুড়ে দীর্ঘদিন চলা তাপদাহের তেজ না কমতেই ভারতের উজানভাগ থেকে তীব্রবেগে নেমে আসছে ঢলের পানি। ভারতে বন্যা সামাল দিতে খুলে দেয়া হচ্ছে বাঁধ-ব্যারাজ-গেট-কপাট। এতে করে সৃষ্ট হঠাৎ প্রবল বন্যায় রীতিমতো দিশেহারা লাখ লাখ মানুষ। একটু শুকনো জায়গা, একটু আশ্রয় ও একমুঠো খাবারের সন্ধানে উঁচু জায়গার দিকে মরিয়া হয়ে ছুটছে বানভাসি অগণিত মানুষ। গতকাল (রোববার) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, উত্তরবঙ্গে বন্যা ব্যাপক ও ভয়াল রূপ নিয়েছে। অন্যতম প্রধান নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা-ধরলা পাড়ের জনপদে ডুবছে নতুন নতুন এলাকা। সেই সাথে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। বাড়ছে নদীভাঙন।

গতকাল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫টি নদ-নদী ২৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। ৯৩টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে পানি বৃদ্ধি পায় ৭৩টি পয়েন্টে। পানি হ্রাস পায় ১৮ পয়েন্টে। এ যাবৎ ১৬টি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, বগুড়া, জামালপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কক্সবাজার। চট্টগ্রাম ও সিলেটের কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তরা আশ্রয় ও খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে। তবে কিছু ছিটেফোঁটা ছাড়া প্রয়োজনীয় খাদ্যসহ ত্রাণ সাহায্য মিলছে না।
বন্যা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, দেশের উত্তরবঙ্গ, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রধান সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি অনুযায়ী এটি মধ্যমেয়াদি বন্যা। যা এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহেরও কম সময় স্থায়ী হতে পারে। ১৫ জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে ঢল নামছে। অভ্যন্তরীণ ভারী বর্ষণও হচ্ছে। এরফলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় অন্যতম প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদ সিরাজগঞ্জে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

তিনি জানান, উত্তরের বন্যা বিস্তৃত হতে চলেছে মধ্যাঞ্চলেও। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই মধ্যাঞ্চলের বিশেষ করে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। ঢাকা ও এর আশপাশে নদীগুলোর পানি বাড়তে পারে। তবে আপাতত ঢাকায় বন্যার আশঙ্কা নেই। তবে গঙ্গা-পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় গোয়ালন্দে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। বিহার ও নেপালে আরো কিছু দিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে গঙ্গা-পদ্মায় পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে।

পাউবো সূত্রে গতকাল সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে প্রধান নদ-নদীর প্রবাহ ও বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়, দেশের উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। উত্তর জনপদের প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ও চিলমারি পয়েন্টে ৭৬ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যতম প্রধান নদ যমুনা ৬টি পয়েন্টের মধ্যে চারটিতেই বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে যমুনা-ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৩ সে.মি., বাহাদুরাবাদে ৯০ সে.মি., সারিয়াকান্দিতে ৪৫ সে.মি., কাজীপুরে ২০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জে যমুনা বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে (মাত্র ১০ সে.মি. নিচে)।

উত্তর জনপদের ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম জেলায় বিপদসীমার ৮১ সে.মি. ওপর দিয়ে বইছে। তিস্তার বন্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখলেও এখন ভারত উজানে গজলডোবা বাঁধের সবকটি গেট-কপাট খুলে দিয়ে নিজেদেরকে বন্যামুক্ত রাখছে। এ অবস্থায় তিস্তা পাড়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা অব্যাহত রয়েছে। তিস্তা ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাগট নদীর গাইবান্ধা জেলায় বিপদসীমার ৫৬ সে.মি. ওপরে বইছে।

উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি প্রধান নদীর ঢলের তোড়ে দেশের মধ্যাঞ্চলও এ মুহূর্তে বন্যার মুখোমুখি রয়েছে। ধলেশ্বরী নদী টাঙ্গাইলের এলাসিনে বিপদসীমার মাত্র ২৩ সে.মি. নিচে রয়েছে। এদিকে ভারতের উজানে অতিবৃষ্টির কারণে অব্যাহত ঢলের মুখে গঙ্গা-পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল পদ্মা গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৪ সে.মি. নিচে এসে গেছে। সবকটি পয়েন্টে বাড়ছে গঙ্গা-পদ্মার পানি।

আপার মেঘনা অববাহিকায় নদ-নদীসমূহ এখন পর্যন্ত বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে সুরমার তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার ৬১ থেকে ১৩২ সে.মি. উপরে, কুশিয়ারা দুটি পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৮ থেকে ১৬১ সে.মি. ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া মনু, খোয়াই, ধলই, সোমেশ্বরী, কংস বিপদসীমার ঊর্ধ্বে রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম পাহাড়ি অববাহিকায় খর¯্রােতা নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ রেকর্ডে সাঙ্গু নদী বান্দরবানে বিপদসীমার ২৫৫ সে.মি. এবং দোহাজারীতে ১৫৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মাতামুহুরী নদী লামায় ৭০ সে.মি., চিড়িঙ্গায় ৮২ সে.মি. ঊর্ধ্বে রয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘলায়, অরুনাচল, ত্রিপুরা, মিজোরাম, সিকিম ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের বিহার ও নেপালে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এসব অঞ্চলে আরও ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।

এ অবস্থায় আগামী ৭২ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে সুরমায় পানি কমতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদ সিরাজগঞ্জে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ সময় সিলেট ও রংপুর বিভাগের কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ধরলাসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কমবেশি অবনতি ঘটতে পারে। তবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীর উজানভাগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে জলপাইগুড়িতে ২০৭ মিলিমিটার, আগরতলায় ১১৯ মি.মি., কৈলাশহরে ৭৬ মি.মি., শীলচরে ৮০ মি.মি., চেরাপুঞ্জিতে ৫১ মি.মি.। বর্ষার মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় থাকায় দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি থেকে ভারী, কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পঞ্চগড়ে ২০০ মি.মি., ডালিয়ায় ১৭৭ মি.মি., রাঙ্গামাটিতে ১২৫ মি.মি., টাঙ্গাইলে ১২২ মি.মি., মহেশখোলায় ১৯০ মি.মি., নরসিংদীতে ২০৮ মি.মি., ঢাকায় ১০২ মি.মি., শ্রীমঙ্গলে ২৫০ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগ আগামী ৫ দিন হিমালয় পাদদেশীয় ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তর পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, ত্রিপুরা, সিকিমে মাঝারি থেকে ভারী কিংবা অতিভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে করে ব্রহ্মপুত্র ও বিভিন্ন নদীতে বাড়বে ঢলের তোড়। ইতোমধ্যে আসামে মারাত্মক বন্যা দেখা দিয়েছে।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা, ধারাবর্ষা, বোহাইল, আওলাকান্দি ও ধুনট উপজেলার বৈশাখীর চরের নতুন নতুন এলাকা ক্রমেই প্লাবিত হচ্ছে। লোকজন গবাদি পশু নিয়ে উচুঁ এলাকায় অবস্থান নিচ্ছে। অনেকেই চর থেকে চলে এসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বন্যা মোকাবেলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন পুরোপুরি প্রস্তত বলে জানিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ।

সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটের ১৩ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। একটি উপজেলা বাদ থাকলেও (দক্ষিণ সুরমা) সেটিও আজ প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন প্রায় ৩ লাখ মানুষ। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় বাড়ছে জনদুর্ভোগ। তবে জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, পানিবন্দি মানুষদের সহায়তায় খোলা হয়েছে মোট ১৯৪টি আশ্রয় কেন্দ্র।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ