Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারসাম্যহীন পুঁজিবাজার

বারবার আইন পরিবর্তনেও সুফল নেই

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

পুঁজিবাজার নিয়ে ব্যাংক কোম্পানীর আইনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অনেক আইনে পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই তবে তাতে খুব বেশি সুফল আসেনি। নানামুখি উদ্যোগের পরেও ভারসাম্য হারিয়েছে বাজার। বেশিরভাগ সময়ই বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ঠিকঠাক আচরণ করছে না বাজার বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বিশিষ্ট পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আবু আহমেদ বলেন, আইন-কানুন বাজারে খুব বেশি প্রভাব ফেলছে না।

২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১-এর ব্যাপক সংশোধনী আনা হয়, যা ব্যাংক কোম্পানী (সংশোধনী) আইন, ২০১৩ নামে পরিচিত। সংশোধনীতে ব্যাংক থেকে ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজারে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিংস-এর মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ। পূর্বে এর পরিমাণ ছিলো ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের বা ঋণের ১০ শতাংশ। সংশোধনীর পর অর্থাৎ ২০১৩ সালের সংশোধনীর পর বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সার্কুলারের মাধ্যমে ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজারের নানাবিধ পরিবর্তন আনা হয়। এসব সার্কুলার পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ মনে করা হলেও এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি পুঁজিবাজারে।

সর্বশেষ গত ২৬ মে ডিওএস সার্কুলার নং-৪ অনুযায়ী ইক্যুইটি শেয়ার, নন কনর্ভাটেবল কিউমিলিটিভ প্রিফারেন্স শেয়ার, নন কনর্ভাটেবল বন্ড, ডিবেঞ্চার, ওপেন ইন্ড ফান্ডের বিনিয়োগকে ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার থেকে বাদ দেয়া হয়। এ সার্কুলারের ফলে ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজারের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পুঁজিবাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকগুলোর সাবসিডিয়ারি কোম্পানী থেকে প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, কনসুলেটেড এক্সপোজার ৫০ শতাংশে এ উন্নীতকরণ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভিশনের ব্যবস্থা ইত্যাদি নানাবিধ পরিবর্তন আনয়ন করে কিন্তু এর তেমন কোনো সুফল লক্ষ্য করা যায়নি পুঁজিবাজারে।

আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের সাবেক সিইও এবং মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন বলেন, নোটিফিকেশন জারির পর থেকে অদ্যাবধি বাজারে গুটি কয়েকদিন ছাড়া ট্রেডের পরিমাণ ছিলো অনেক কম এবং বাজারও ছিলো নিম্নমুখী। শুধু তাই নয়, বিএসইসি’র ঘন ঘন রুলস পরিবর্তনেও বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি।

বিষয়টি নিয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র এম. সাইফুর রহমান বলেন, বিএসইসির প্রধান কাজই হলো বিনিয়োগকারীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া, মার্কেটের উন্নয়ন করা এবং এই বাজারের জন্য রুলস রেগুলেশন প্রণয়ন করা। বিগত কয়েক বছরে (২০১০ এর পরে) বিএসইসি যে ধরণের আইন প্রণয়ন ও সংস্কার করেছে; তাতে দেশের পুঁজিবাজারের ভীত আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতি, খাতভিত্তিক অবস্থাসহ সার্বিক অবস্থানির্ভর করে শেয়ারের দর ওঠা-নামার উপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে প্রকাশিত ‘সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ, আইন ও বিধি-বিধান’ সংক্রান্ত বইটি সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ সাল পর্যন্ত সকল আইন ও বিধিবিধান এর সংশোধনীসমূহ সমন্বয় করে তৃতীয় সংস্কার হিসেবে প্রকাশ করে। বইটির সমস্ত আইন ও বিধিমালাসমূহ কমিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত রয়েছে। কমিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী কমিশনের মোট আইন ও বিধিমালার সংখ্যা ৩০টি, যা ৪টি ভাগে বিভক্ত। এর প্রথম ভাগে রয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এবং এর অধীনে প্রণীত ১২টি আইন ও বিধিমালা। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে মোট ১৪টি আইন ও বিধিমালা, যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ এবং এর অধীনে প্রণীত। তৃতীয় ভাগে রয়েছে ডিপোজিটরি আইন, ১৯৯৯ এবং এর অধীনে প্রণীত ৩টি আইন ও প্রবিধানমালা। সর্বশেষ চতুর্থ ভাগে রয়েছে এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন, ২০১৩।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরের থেকে অদ্যাবধি বিএসইসি আরো ১৩টি নতুন আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে অর্থাৎ মাত্র ৬ মাসেই প্রণয়ন করে নতুন ৫টি বিধিমালা। এসব আইন ও বিধিমালার সংশোধনীও হয়েছে প্রচুর। ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত কমিশন মোট ৪৬টি সংশোধনী (নোটিফিকেশন, ডাইরেক্টিভ ইত্যাদিসহ) আনয়ন করে। যার মধ্যে ২০১৯ সালের ৬ মাসেই হয়েছে ১১টি সংশোধন (খসড়া পাবলিক ইস্যু রুলস, ২০১৫ সহ)। ২০১৮ সালে কমিশন মোট ১৩টি সংশোধন আনয়ন করে। এসব সংশোধনীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫। পূর্বে এই পাবলিক ইস্যু রুলস এর নাম ছিলো ‘সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০০৬’। ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালে বিএসইসি ২০০৬ সালের বিধিমালাটি বাতিল করে ‘বাংলাদেশ সিকিউরটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫’ নামে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করে।

গত ৬ জুলাই, ২০১৭ তারিখে বিএসইসি উক্ত পাবলিক ইস্যু রুলস-এর ২০টি সংশোধনী প্রকাশ করে। মাত্র দেড় বছরের মাথায় একটি বিধিমালার এতো পরিবর্তন কোনো মতেই কাম্য নয়। এছাড়াও বিএসইসি উক্ত পাবলিক ইস্যু রুলসের ১১টি ডাইরেক্টিভ, নোটিফিকেশন ইত্যাদি প্রণয়ন করে। বছর যেতে না যেতেই (জুলাই, ২০১৮ থেকে জুন, ২০১৯) গত ৩০ মে, ২০১৯ তারিখে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তাদের ওয়েব সাইটে ও পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫’ এর ১৪টি সংশোধনীর খসড়া পাবলিক মতামতের জন্য প্রকাশ করে। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই উক্ত পাবলিক ইস্যু রুলসের ব্যাপক পরিবর্তন করতে যাচ্ছে বিএসইসি।

এবার আসা যাক আরো কিছু বিধিমালার কথায় যা শুধু প্রকাশিতই হয়েছে কিন্তু এর কোনো কার্যক্রম আজ অবধি শুরু হয়নি। ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) বিধিমালা, ২০১৬’ এর কথাই ধরা যাক। বিধিমালাটি ১৯ জুন, ২০১৬ তারিখের হলেও কমিশন তা তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে ১৩ জুন, ২০১৭ তারিখে। দুই বছরের অধিক সময় পার হলেও এর কোনো কার্যক্রম অদ্যাবধি শুরু হয়নি। অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড নামে এখনও কোনো ফান্ড বাজারে আসেনি আর কবেই বা আসবে তারও কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বাজার সৃষ্টিকারী) বিধিমালা, ২০১৭ কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে ১৩ জুন, ২০১৭ তারিখে। বিধিমালারও কোনো কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। অনুরুপভাবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার বাই স্মল ক্যাপিটাল কোম্পানীজ) রুলস, ২০১৬ প্রকাশিত হয় ২৭ অক্টোবর, ২০১৬ তারিখে। বাংলাদেশ সিকিউরটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ক্লিয়ারিং এন্ড সেটেলমেন্ট) বিধিমালা, ২০১৭ প্রকাশিত হয় ১৩ জুন, ২০১৭ তারিখে। এ সকল বিধিমালা বিএসইসি দুই/তিন বছর পূর্বে প্রকাশ করলেও এর কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি বা কিছুটা শুরু হলেও এর কোনো প্রভাব পুঁজিবাজারে প্রতিফলিত হয়নি। তাহলে কেনইবা এতো বিধিমালা প্রণয়ন করছে বিএসইসি, তা নিয়ে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। ২০১৯ সালের ২৮ এবং ২৯ মে বিএসইসি মোট চারটি নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করে। এসব বিধিমালারও কার্যক্রম শুরু হবে কবে তাও বোধোগম্য নয়।

এবার আসি একটি গুরুত্বপূর্ণ নোটিফিকেশন এর বিষয়ে, যা বিএসইসি তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে ২১ মে, ২০১৯ তারিখে। যার নম্বর বিএসইসি/সিএমআরআরসিডি/২০০৯-১৯৩/২০১৭/এডমিন/৯০। যেখানে সকল স্পন্সর এবং ডাইরেক্টরদের ৩০% এবং ইনডিভিউজুয়াল ডাইরেক্টরদের ২ শতাংশ শেয়ার হোল্ডিং-এর কথা বলা হয়েছে। উক্ত নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে বিএসইসি পূর্বের ৫টি নোটিফিকেশন বাতিল করে। তার মানে হচ্ছে ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে ৫টি নোটিফিকেশন জারি ছিলো। এর মধ্যে ১টি ১১ মার্চ, ২০১৮ তারিখের। প্রশ্ন হচ্ছে, এতোগুলো নোটিফিকেশন বাতিল করে নতুন নোটিফিকেশন জারির ফলে বাজারে কি-এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে? পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নোটিফিকেশনটি জারির পরের দিনই অর্থাৎ ২২ মে, ২০১৯ তারিখে ডিএসইতে ট্রেডের পরিমাণ ছিলো মাত্র ২৯০ দশমিক ৫ কোটি টাকা। যা পূর্বের দিনের তুলনায় প্রায় ১৭ দশমিক ৪শতাংশ কম। শুধু তাই নয়, উক্তদিনের ট্রেড ছিলো ২০১৯ সালের নিম্নের দিক থেকে ৬ষ্ঠ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ও বিশিষ্ট পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার আইন পরিবর্তনেও বাজারে গতি ফিরে পাচ্ছে না। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো অতীব জরুরি এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকেও আস্থা রাখতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ