Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জিটিসির স্বেচ্ছাচারিতা

দিনাজপুরের মধ্যপাড়া খনি প্রকল্প

মাহফুজুল হক আনার | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশের একমাত্র কঠিন শিলার ভূ-গর্ভস্থ খনি থেকে গত তিন মাস পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। কবে পাথর উত্তোলন শুরু হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। 

গত এপ্রিল মাসে মোটরের একটি পিনিয়াম ভেঙে গেলে উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। চুক্তি মোতাবেক বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোটিয়াম (জিটিসি) খনি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের সকল দায়িত্ব পালন করবে। পাথর উত্তোলন করে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে চুক্তির নির্ধারিত দরে বিক্রি করবে। চুক্তির শর্ত মোতাবেক জিটিসি পিনিয়াম এনে মেশিন চালু করবে। কিন্তু তা না করে পিনিয়াম ক্রয়ের জন্য পেট্রোবাংলার অধিনস্ত মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কর্তৃপক্ষের কাছে পিনিয়াম কেনার জন্য নতুন কার্যাদেশ অর্থাৎ চুক্তির বাহিরে নতুন করে টাকা দাবি করছে। এখানেই শেষ নয় চুক্তির শুরুতেই মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কর্তৃপক্ষের কাছে নেয়া অগ্রিম টাকা ফেরতে টালবাহানা করছে। মাইনিং কর্তৃপক্ষকে জামানত হিসাবে দেয়া ব্যাংক গ্যারান্টি থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করলে জিটিসি আদালতের মাধ্যমে তা আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্ত প্রথম দফায় তারা হেরে গেলে মধ্যপাড়া অফিসের কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছে।

একটি সূত্রের মতে, শর্তের মাত্র ৩৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে আবার নতুন করে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য উপর মহলে দেন দরবার করছে। মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কর্তৃপক্ষ বিদেশী এই প্রতিষ্ঠানটির জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে টেন্ডার আহবানের কার্যক্রম শুরু করেছে। এদিকে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছে এক হাজারের বেশি শ্রমিক। মজুদ থাকা পাথরও তিন মাসের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে। ফলে বেকার হয়ে পড়বে লোড-আনলোডের সাথে জড়িত আরো ৫শ’ শ্রমিক। বন্ধ হয়ে যাবে দেশের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) মো. আবু তালেব ফারাজি জানান, দেশের একমাত্র ভূ-গর্ভের মজুদ থেকে কঠিন শিলা (পাথর) উত্তোলনের জন্য জার্মানী কোম্পানী জিটিসির সাথে চুক্তি করে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানী। ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ছয় বছরের জন্য চুক্তি সম্পাদনের পর ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী খনি হস্তান্তর করা হয়। খনি পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণসহ চুক্তিকালীন সময়ে জিটিসি ৯২ লক্ষ মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন ও ন্যুনতম ১২টি স্টক (খনি মুখ) এর উন্নয়ন করার কথা। প্রতি টন ১২ ডলার হিসাবে উত্তোলিত পাথরের মূল্য মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কর্তৃপক্ষ জিটিসিকে প্রদান করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো চুক্তির নির্ধারিত সময় আর মাত্র ৮ মাস বাকি থাকলেও জিটিসি এ পর্যন্ত মাত্র ৩০ দশমিক ৭৬ লক্ষ মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন ও ৬টি স্টকের উন্নয়ন করে। অর্থাৎ পাথর উত্তোলন করে মাত্র ৩৩ শতাংশ এবং স্টক উন্নয়ন করেছে ৫০ শতাংশ।

চলতি বছরের ৩ এপ্রিল রাত ৯টায় ক্রিপ মোটরের পিনিয়াম ভেঙে গেলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চুক্তি মোতাবেক জিটিসি নষ্ট হওয়া যন্ত্রপাতি আমদানী বা ক্রয় করার কথা থাকলেও তারা তা করছে না। প্রথম পর্যায়ে জিটিসি পিনিয়াম ক্রয়ের জন্য নতুন কার্যাদেশ দাবি করলে খনি কর্তৃপক্ষ চুক্তির শর্ত মোতাবেক কার্যাদেশ প্রদান করেনি। এরপর থেকেই জিটিসি নীরব হয়ে যায়। এমনকি খনি এলাকায় জিটিসি অফিসে স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কার্যাদেশ না দেয়ার সিদ্ধান্তে খনি কর্তৃপক্ষের সাথে জিটিসি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। একইসাথে চিঠির উত্তরও দিচ্ছে না বলে জানান জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন)।

একইসাথে চুক্তির শুরুতে মেশিনারী আমদানী ও খনি রক্ষণাবেক্ষণ খাতে জিটিসিকে অগ্রিম হিসাবে দেয়া ১৭ কোটি ৬৬ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা আদায় করতেও খনি কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চুক্তি মোতাবেক উৎপাদনে যাওয়ার ২৩ মাস পর থেকে মোট ৪৮ কিস্তিতে এই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। যার একটি কিস্তিও জিটিসি পরিশোধ করেনি। অপরদিকে এ পর্যন্ত উত্তোলিত ৩০ দশমিক ৭৬ লক্ষ মেট্রিক টন পাথরের মূল্য বাবদ পুরো অর্থ জিটিসি নিয়ে নিয়েছে। পক্ষান্তরে আর মাত্র ৮ মাস রয়েছে চুক্তির মেয়াদ। এর মধ্যে ভেঙে যাওয়া পিনিয়াম এনে স্থাপন করে পুনরায় পাথর উত্তোলন করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ জিটিসির দেয়া ব্যাংক গ্যারান্টি থেকে কর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এতেও একের এক আইনি জটিলতায় ফেলে এই টাকাও কর্তনে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। অন্যদিকে খনি কর্তৃপক্ষ নতুন কোম্পানীর সন্ধানে টেন্ডার আহবানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এখানেও জিটিসি উপর মহলে দেনদরবার করে যে কোন উপায়ে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে। এই কারণে পাথর উত্তোলন বন্ধ হওয়ার আগে দিনক্ষণ হিসাব দেখিয়ে পাথর উত্তোলন করার খবর প্রচার করে জিটিসি কর্তৃপক্ষ।

এদিকে পাথর উত্তোলন বন্ধ এবং নির্ধারিত পরিমাণ পাথর উত্তোলন না করায় মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানীকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খনির সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানী। উত্তোলিত পাথর বিক্রির মাধ্যমেই এই ঋণ পরিশোধ করার কথা। এখন ঋণ পরিশোধ দূরের কথা নিয়মিত ঋণের সুদ দেয়াই কষ্টকর হয়ে পড়বে।

চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাথর উত্তোলন না করা এবং উত্তোলন বন্ধ থাকায় খনি কর্তৃপক্ষকে ঋণের বোঝাসহ অফিস মেইনটেনেন্সে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। গত অর্থবছরে সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশী লোকসান গুনতে হয়েছে। সঠিকভাবে পাথর উত্তোলন করা হলে মধ্যপাড়া খনি প্রকল্প ইতিমধ্যেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো। কেননা মধ্যপাড়া খনির পাথরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সূত্রটির মতে, গত মে মাসে ৬৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর বিক্রি করেছে। জুন মাসে অতি চাহিদাপূর্ণ একটি সাইজের পাথর শেষ হয়ে যাওয়ায় বিক্রি হয়েছে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন।

উল্লেখ্য যে, বর্তমানে চার লক্ষ ৪৫ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন পাথর মজুদ রয়েছে। যা আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। পাথর শেষ হয়ে গেলে মধ্যপাড়া পাথর খনি মরুভ‚মির রুপ ধারণ করবে। এ অবস্থায় অর্থ পিপাসু বিদেশী কোম্পানীর জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করে দেশের একমাত্র পাথর খনিকে সচল করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ