Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সঙ্কটাপন্ন সুন্দরবন

৬ কিলোমিটারের মধ্যেই শিল্প কারখানা স্থাপন : ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে ইউস্কো

আবু হেনা মুক্তি | প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

সঙ্কটে পড়েছে সুন্দরবনের ঐতিহ্য। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে মানুষষের আগ্রাসনে ঐতিহ্য হারাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ম্যানগ্রোভ বন। পাশাপাশি বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা ২০১৯ থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের সুন্দরবন। বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন, নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটন, বন্যপ্রাণী নিধন, অবাধে গাছ কাটা এবং বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন।

সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’ ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে গড়ে উঠছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গত ৮-১০ বছরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০টি ভারী শিল্পকারখানা। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা, এলপি গ্যাস প্লান্ট, তেল শোধনাগার, বিটুমিন এবং সামুদ্রিক মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। এসবের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের ওপর।

পরিবেশ প্রেমীদের একের পর এক মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনে আর আন্দোলন করেও সুন্দরবনকে বাঁচানোর আকুতি মিনতি কেউ শুনছে না। বাংলাদেশের গর্ব সুন্দরবন আজ সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক সঙ্কটের মুখে। এই বন আর কৃত্রিমভাবে তৈরি সম্ভব নয়। এটিই সুন্দরবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অতএব এই বন ধ্বংস হলে শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্ব চিরদিনের মত অমূল্য সম্পদ হারাবে।

বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ কিলোমিটার। আয়তনের প্রায় ৭০ ভাগ স্থল আর ৩০ ভাগ জল। পুরো সুন্দরবনের ভেতরে জালের মত অসংখ্য নদী আর খাল রয়েছে। প্রায় ৪শ’ প্রজাতির পাখির বসবাস এই বনে। জীববৈচিত্রে ভরা সুন্দরবনকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

অথচ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা ২০১৯ থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের সুন্দরবন। সম্প্রতি সংস্থাটি থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন জায়গার মধ্যে শুরুতেই আছে বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনটি।

সুন্দরবনকে এখন বন্যপ্রাণীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি এর কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া, বন উজাড়সহ পরিবেশবিরোধী কাজের অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবনকে ইউনেস্কো বাদ দিতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এদিকে, সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করলেও ৬ কিলোমিটারের মধ্যেই শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সঙ্কটাপন্ন এলাকায় পরিবেশ দূষণকারী শিল্প কারখানা স্থাপনে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা হয় না। তারপরও ৫টি বায়ু দূষণকারী সিমেন্ট কারখানাকে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে।

সম্প্রতি খুলনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, “রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সরকারের সুন্দরবন বিধংসী কর্মকান্ডের কারণেই বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবনকে বাদ দিচ্ছে ইউনেস্কো। এটা শুধু আমাদের জন্যে নয়, সারা বিশ্বের প্রতিবেশ-পরিবেশ সুরক্ষার জন্য হুমকি স্বরূপ।”

তিনি বলেন, আসন্ন ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্য কমিটির সভায় বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের সুপারিশগুলোর ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সুন্দরবন বিষয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের সুপারিশ যদি চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে সুন্দরবন তার বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির খুলনা বিভাগীয় মহাসচিব মো: আজগর হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, সুন্দরবন কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্ববাসীর সম্পদ। আমরা এই বনের গর্বিত অভিভাবক। এই গবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বন রক্ষায় আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। আমাদের সম্পদ, গর্ব, রক্ষাবর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতীক সুন্দরবনকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’
তারা আরও বলেন, ‘সুন্দরবনের সবকিছুই সারা পৃথিবীতেই অদ্বিতীয়। এর গাছ ও পশুপাখি অন্য কোনও বনে বা স্থানে বঙ্কানুক্রমিকভাবে বাঁচবে না। এই বন আর কৃত্রিমভাবে তৈরি সম্ভব নয়। এই বন ধ্বংস হলে শুধু আমরা নই, সমগ্র বিশ্ব চিরদিনের মত অমূল্য সম্পদ হারাবে।’

সুন্দরবন রক্ষায় বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন তিনি। তা হলো- রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সরকারি পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করা, বনের পাশ ঘেষে বরাদ্দকৃত সব শিল্প ও আবাসন প্লট বাতিল করা। সুন্দরবনের অপরিকল্পিত গাছকাটা, পশুপাখি হত্যা ও মাছ ধরা বন্ধ করা। বন থেকে মোবাইল টাওয়ার অপসারণ করা ইত্যাদি। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আজ ধ্বংসের পথে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বনের ভেতর ঢুকে চুরি করে কাঠ সংগ্রহ করছে। প্রশ্ন হল প্রশাসন তাহলে কী করছে? যে সুন্দরী গাছের জন্য সুন্দরবন বিখ্যাত, সেই গাছের সংখ্যাও এখন আশঙ্কাজনক হারে কমছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ