Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্ষায় ডুববে রাজধানী

দায়িত্ব নিয়ে ওয়াসা-দুই সিটির রশি টানাটানি

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

বর্ষা এসে গেছে। রাজধানীতে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তির কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি এখনো। পানিবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা এখন পর্যন্ত কোনো জলাশয় পুরোপুরি পরিষ্কার করেনি। পুনর্খনন করেনি কোনো খাল। এমনিতেই নিয়মিত পরিষ্কার না করায় রাজধানীর নিচু জমিন, ঝিল, জলাশয় ও লেকগুলো হয়ে উঠেছে কচুরিপানা ও আবর্জনার ভাগাড়। দিন দিন ময়লা আবর্জনা ফেলে আসাধু চক্র সরকারি এ জলাশয়গুলো দখল করে নিচ্ছে।
দুই সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে প্রতিবছরই এই জলাশয়গুলোর আয়তন কমছে। এসব নিচু জমিন, ঝিল, জলাশয় ও লেকগুলোর কচুরিপানা ও নোংরা আবর্জনায় একদিকে জন্মাচ্ছে মশা। অন্যদিকে এই ময়লা আবর্জনার কারণে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে নিষ্কাশন হতে না পেরে সৃষ্টি হচ্ছে পানিবদ্ধতার। যে কারণে এবছর বর্ষাতেও ঘণ্টায় মাত্র ৪০ মিলিমিলটার বৃষ্টিপাত হলেও রাজধানীতে পানিবদ্ধতা দেখা দিবে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট বিভাগে কথা বলে জানা গেছে, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের বাইরে পানিবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ কোন পদক্ষেপ তাদের নেই। এবারে রাজধানীবাসীর প্রকৃতিই ভরসা। বৃষ্টি কম হলে রক্ষা আর বেশি হলে পানিবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ পাবে। তখন ডুবন্ত ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকবে না বলে জানা গেছ। তবে ঢাকার দুই মেয়র বলছেন, পানিবদ্ধতা কমাতে নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বছরের পর বছর কথা হলেও রাজধানীর পানিবদ্ধতা সমস্যার কোনো সুরাহা খুব একটা হচ্ছে না।
প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস সময়ে রাজধানীর খাল ও বদ্ধ জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে থাকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। পাশাপাশি চালানো হয় বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি। এবছর কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। দুই সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে নেয়া হয়নি বিশেষ কোনো পরিচ্ছন্নতা অভিযানও। ফলে এ বছরের বর্ষাতে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতার দুর্ভোগে পড়বে নগরবাসী।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানা গেছে, রাউজক, গণপূর্ত অধিদফতর, সিভিল এভিয়েশন, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এ খাল ও জলাশয়গুলোর মালিক। এছাড়া ব্যক্তি মালিকানায়ও রয়েছে কিছু জলাশয়। তাদের ভাষ্য, এসব জলাশয় পরিষ্কারের জন্য কর্পোরেশনের আলাদা বাজেট নেই। তাছাড়া এগুলো পরিষ্কারের দায়িত্বও তাদের নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই। তা হলে পানিবদ্ধতা হবে না কেন? জানা গেছে, রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নিয়ে ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে আছে রশি টানাটানি। ১৯৮৯ সালে ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি এ কাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরো কয়েকটি সংস্থা।
ওয়াসা ২০১৪ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, পানিবদ্ধতার দায় ওয়াসা নেবে না। কারণ, পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হলেও ওয়াসার চেয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাইপলাইনের সংখ্যা বেশি। বার্ষিক ক্লিনিংয়ের ব্যাপারেও দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। এ জন্য সামান্য বৃষ্টিতেই পানিবদ্ধতা দেখা দেয়।
গণপূর্ত এবং পানি সম্পদমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিয়ে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে আলোচনায় বসেন মরহুম মেয়র আনিসুল হক। মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে দায়িত্ব নিতে আগেই খাল পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্তের শর্ত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই শর্ত অনুযায়ী পানিবদ্ধতা নিরসনে রাজধানীর খাল পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্ত করে ৯ মাসেও সিটি কর্পোরেশনে হস্তান্তরের কাজ করতে পারেনি ওয়াসা।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ওয়াসার যখন যেমন টাকা থাকে, তখন তেমন ব্যয় করি। ড্রেনেজে আমাদের অংশের কাজকর্ম ঠিকই আছে। খাল পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্ত করে সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে ওয়াসার প্রস্তুতি পরবর্তীতে জানানো হবে।
পানিবদ্ধতার ভয়াবহতা দেখে ২০১৭ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (পানিবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছু দিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, পানিবদ্ধতার জন্য আমরা একটা জায়গায় সমাধান করলে আবার অন্য জায়গায় সমস্যা দেখা যায়। আমরা আশা করছি এবার গত বারের তুলনায় পানিবদ্ধতা কিছুটা কম হবে। তবে একেবারে যে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে তা আমরা বলতে পারব না। অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, খুব দ্রুতই আমাদের প্রতিটি এলাকার খালগুলোকে দখলমুক্ত করে সচল করতে পারলে পানিবদ্ধতা অনেকটা কমে যাবে।
এটা মেয়র হওয়ার পর আমার প্রথম বর্ষা। আমি কিছু সময় চাই পরিস্থিতির উন্নয়নের। মৌসুমের শুরুতেই চলতি বছরেও বর্ষা এলেই চিরচেনা ঢাকা রূপ নেয় এক ভিন্ন নগরীতে। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে যায় প্রধান সড়ক থেকে অলিগলির ভেতরে। আর অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি এই দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। যানজটের শহর ঢাকা পরিণত হয় প্রায় অচল এক নগরীতে। গুলিস্তান, শান্তিনগর, নিউমার্কেট, কারওয়ানবাজার, মিরপুর, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ সব এলাকার একই অবস্থা। মেট্রোরেলের কারণে মিরপুর এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রায় ভঙ্গুর। তাই অল্প বৃষ্টিতেই পড়তে হয় পানিবদ্ধতায়। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এখনো সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় বছরজুড়ে এলোমেলো কাজ হলেও তা আসলে কোনো কাজে আসছে না।
এ নিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সমন্বিত কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতি আমরা এই শহরের জন্য নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ততটা আগায়নি। কাজের ধারাবাহিকতায়ও আমাদের সমস্যা রয়ে গেছে। মেয়র যাই বলুন নগরবাসী জানে পানিবদ্ধতায় ভোগান্তি কতটা। তিনি বলেন, এবারেও বিগত বছরগুলোর থেকে রাজধানীতে কম পানিবদ্ধতা হবে এমনটা আশা করার আমার কাছে কোনো যৌক্তিকতা নেই। চলতি বছরেও পানিবদ্ধতায় ভুগতে হবে রাজধানীবাসীকে।
বিআইডবিøউটিএর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং নগর বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, পানির ধর্মকে অস্বীকার করে আমরা ঢাকা শহর থেকে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছি। ঢাকার মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি। ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না। পানি সাধারণত নিচের দিকে যায়। আর যদি যেতে না পারে তাহলে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ঢাকার প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ করে অন্য কোনো ব্যবস্থায় এই পানিবদ্ধতা দূর করা কঠিন।
নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, দোয়া করতে হবে এবার যেন গত বছরের মতো এক সঙ্গে বেশি বৃষ্টি না হয়। বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেছেন, আশির দশকে নগর বন্যার পর ফ্লাড অ্যাকশন প্রোগ্রাম (ফ্যাপ)-এর আওতায় ঢাকার চারপাশ ঘিরে একাংশে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি হয়। কিন্তু পুরো কাজ আর হয়নি।
তিনি আরো বলেন, নদী-খাল ভরাট করে আমরা রাস্তা বানিয়েছি। ফলে এখন পানিবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ঢাকা শহরের মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল। ওয়াসা বলেছিল, এর মধ্যে কমপক্ষে ২৬টি খালকে রক্ষণাবেক্ষণ করে পানিপ্রবাহ সচল রাখবে। কিন্তু বাস্তবে তো তা আর হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ