Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

নানামুখী পদক্ষেপে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে ৩৯ দশমিক ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ২০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাংলাদেশে এসেছিল। এই অর্থবছরের (২০১৮-১৯) একই সময়ে এসেছে ২৮৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই নয় মাসে এফডিআই বেড়েছে ৩৯ দশমিক ২১ শতাংশ। এই সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ দেশে এসেছে ৪৩১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি।

২০১৮ সালে দেশে মোট নিট এফডিআই এসেছিল ৩৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার; যা ২০১৭ সালের তুলনায় ১৪৬ কোটি ডলার বা ৬৭ দশমিক ৯০ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালে দেশে সরাসরি নিট বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল ২১৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার।

গত বছর দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার মধ্যে ইক্যুইটি মূলধন বা নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১১২ কোটি ৪১ লাখ ডলার। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৫৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে বহুজাতিক কোম্পানির পুনর্বিনিয়োগ হিসেবে এসেছে ১৩০ কোটি ৯১ লাখ ডলার। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১২৭ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। এ ছাড়া গত বছর আন্তঃকোম্পানির ঋণ হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১১৮ ডলার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক মাস আগে যেভাবে আমদানি বাড়ছিল সেটা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটত। বছরের শেষ ভাগে এসে আমদানি কমায় সে ঝুঁকি অনেকটা কেটে গেছে। আমদানি কমায় ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতিও কমে আসছে। একই সঙ্গে কমছে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি।

এর আগের বছরেও দেশে ৩৫০ কোটি ডলারের বেশি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ৬৮ শতাংশ বেশি। এক বছরের হিসাবে এটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং ৩০০ কোটি ডলারের ঘর ছোঁয়ার নতুন মাইলফলক। এর আগে ২০১৫ সালে প্রথমবার বিদেশি বিনিয়োগ ২০০ কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্ভে প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

নিজ দেশের বাইরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশিরা অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ডুইং বিজনেস সূচক, ব্যবসার ছাড়পত্র এবং জমি ও শ্রমের সহজলভ্যতা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২১ সালে মধ্যম ও ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য পূরণে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। বিশেষ করে বছরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে এক হাজার কোটি ডলার।

ডুইং বিজনেস সূচকের মাধ্যমে একটি দেশে ব্যবসা করার নিয়মকানুন ও প্রক্রিয়া কতটা সহজ বা কঠিন, তার তুলনামূলক চিত্র উঠে আসে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সংক্রান্ত ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী, ১৯০টি দেশের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম। ২০১৭ সালে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। অর্থাৎ গত বছর অবনতি হয়েছে। তবে ২০২১ সালের মধ্যে ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১০০-র নিচে আসতে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এরই মধ্যে বিডায় পাইলট আকারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যেখানে মিলছে প্রায় ১৫টি সেবা।
২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আট বছরে বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ নিবন্ধন চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ সময়ে প্রকল্পের সংখ্যা ২৩ শতাংশ ও বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮৯ শতাংশ বেড়েছে। তবে কর্মসংস্থানের প্রস্তাব কমেছে ১৭ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন প্রযুক্তির কারণে বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান ততটা হচ্ছে না। যেসব কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, সেখানে যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষার সঙ্গে বাজারের চাহিদার মিল নেই।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, উদ্যোক্তারা ভালো মানের পণ্য কম খরচে তৈরি করতে চায়। এ জন্য তারা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বাজারে প্রচুর কর্মসংস্থান আছে। সেখানে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য দক্ষ লোক পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র চাইলে এক বছরের মধ্যে করে ফেলা যায়। ভাড়ায়ও আনা যায়। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীকে এসএসসি পাস করাতেই ১০ বছর লাগে। আমাদের এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ও এ দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে এত দিন বিনিয়োগকারীদের ধারণা ছিল না। এখন সেটা নানাভাবে বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। এ দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো খুব ভালো ব্যবসা করছে, উচ্চ হারে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে। জাপানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা জেট্রোর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মুনাফার সম্ভাবনা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। ব্যবসা সহজ করতে বিডা কাজ করছে, যা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়িয়েছে।

জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল গত বছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে আকিজ গ্রæপের তামাক ব্যবসা অধিগ্রহণ করেছে। সে অর্থ এখনো আসেনি উল্লেখ করে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, ২০১৮ সালে আসা বিনিয়োগগুলো ২০১৬ ও ২০১৭ সালের দিকে নিবন্ধিত। গত দুই বছরে দেশে প্রচুর বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে প্রকৃত বিনিয়োগ আরও বাড়বে।

সউদী বিনিয়োগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতকালের সংবাদ সম্মেলনের আগে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, সউদী বিনিয়োগ নিয়ে একাধিক সভা হয়েছে। ওআইসিতে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বিষয়টি দেখছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার বক্তব্যে এ বিষয়ে বলবেন বলে উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে সরকারের করা অঙ্গীকারের প্রতিফলন থাকবে। তৈরি পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল, চামড়া, আইসিটি, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ, ফল ও ফসল সংরক্ষণ শিল্প, আবাসন, অটোমোবাইলসহ শিল্পনীতিতে অগ্রাধিকার খাতের তালিকায় থাকা সম্ভাবনাময় শিল্প সম্প্রসারণে আগামী বাজেটে এনবিআরের নীতি সহায়তা বহাল থাকবে।

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আনার উদ্যোগ থাকছে। মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে তিন বছরের মধ্যে বেরসকারি বিনিয়োগ ২৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৮ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এ ক্ষেত্রে ইকোনমিক জোনগুলো দ্রæত চালুর উদ্যোগ থাকছে। ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সহজীকরণ করা হবে। পাশাপাশি যেন সহজেই ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া যায় সে উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ছাড়া সরকারি বিনিয়োগ আট শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। কর্মসংস্থান তৈরিতে থাকছে বিশেষ নজর। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে এক কোটি ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম মনে করেন, সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে শিগগিরই বাংলাদেশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি বলেছেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার কাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচকে বাংলাদেশের যে ঘাটতি রয়েছে, তা দ্রুত পূরণের চেষ্টা চলছে। এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেয়া শুরু হয়েছে। আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বাড়ছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার মজুত বেড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশের ওপরে রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি সহনীয়। এমনকি নির্বাচনের বছরেও অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি। দেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার অত্যন্ত বিনিয়োগবান্ধব। তিনি বলেন, নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য জনশক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগব্যবস্থা, তথ্য-প্রযুক্তি প্রভৃতি খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিক মুনাফার দিক থেকে বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

বিডা সূত্রে জানা গেছে, ডুয়িং বিজনেসে পিছিয়ে থাকলেও সামাজিক ও অন্যান্য সূচকে অনেক উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। এজন্য বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। ফলে ইক্যুইটি বা নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে। আবার যারা আগে থেকে এখানে আছে তারাও উল্লেখযোগ্য পুনর্বিনিয়োগ করছে। মোট কথা, যারা বাংলাদেশে একবার বিনিয়োগ করে, তারা আর ফেরত যেতে চায় না। এখানে রিটার্নও পাওয়া যায় বেশি।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রণোদনা ও বিভিন্ন উৎসাহমূলক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে অন্তত ১৭টি খাতে কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে বিদেশিরা। বিদেশিদের মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিধিবিধান শিথিল করা আছে। মুনাফাসহ শতভাগ মূলধন ফেরত নেয়ার পাশাপাশি নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠায় যন্ত্রপাতির অবচয় সুবিধা, শুল্কমুক্ত যন্ত্রাংশ আমদানি এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে বিদেশিরা। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের একটি কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) প্রতিষ্ঠার অনুমতি দান। এসব সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ