আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জিয়াউর রহমান
মুনশী আবদুল মাননানআন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব,
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
আজ জিয়াউর রহমানের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। জিয়াউর রহমান ইতিহাসে নিজের নামই শুধু লিখে যাননি, ইতিহাস সৃষ্টিতেও রেখে গেছেন সুস্পষ্ট অবদান। তার সততা, দেশপ্রেম ও কর্মোদ্যোগ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে। জিয়া মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন বড় কিছু করতে, তার চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। এ দেশের দুটি ক্রান্তিলগ্নে ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে জিয়াউর রহমান পালন করেছেন নিয়ামকের ভূমিকা। একটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, আরেকটি ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর। এই দুই ক্ষেত্রেই সে দায়িত্ব পালনে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। অথচ অনিবার্য বাস্তবতা হলো দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। প্রকৃতিই যেন দায়িত্ব নিতে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দুই ক্ষেত্রেই সে দায়িত্ব পালনে তিনি সফল হয়েছেন এবং ইতিহাসও সৃষ্টি করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উন্মেষ ঘটে কার্যত স্বাধীনতার মহান ঘোষক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। অল্প সময়ে যে অনেক বড় আকারের পরিবর্তন আনা যায় এবং বদলে দেয়া যায় রাজনীতি ও দেশকে, তার সুস্পষ্ট উদাহরণ জিয়াউর রহমান। তিনি মাত্র কয়েক বছরে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। তার হাত ধরে একদলীয় বাকশাল থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। তিনি উন্মুক্ত করে দেন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। তলাবিহীন ঝুড়ির উপাধি পাওয়া দেশকে পরিণত করেন উন্নয়নশীল ও সম্ভাবনাময় দেশে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। জিয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারা এখন বাংলাদেশের মূলস্রোত। জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ দর্শনের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন আমাদের জাতীয় পরিচয়। তাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ অটল-অবিচল রয়েছে। এসব একটি জাতির জন্য অনেক বড় আকারের পরিবর্তন এবং অর্জন। মাত্র কয়েক বছরে জিয়াউর রহমান এই পরিবর্তন আনেন, যা রীতিমতো বিস্মিত হওয়ার মতো। কেবল তীক্ষè বুদ্ধি, প্রগার দেশপ্রেম, সততা-নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা এবং দূরদর্শিতা থাকলেই তা সম্ভবÑ জিয়াউর রহমানের মধ্যে এর সবগুলো গুণ ছিল। তাই তিনি পেরেছেন। ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে জিয়াউর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন।
যোগ্যতা, শ্রম ও একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের মেল বন্ধনে সকল বিঘেœর প্রাচীরকে চূর্ণ করে শেষ পর্যন্ত জিয়া পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শীর্ষতম বিন্দুতে। জনপ্রিয়তা আর জিয়া পরিণত হয়েছিলেন এক ও অভিন্ন সত্তায়। অনৈক্য ও বিভাজনের কঠিন বৃত্ত থেকে তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বের করে এনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অঙ্কন করেছেন নিজের সাফল্য চিহ্ন। দর্শন চিন্তা, সাংগঠনিক চিন্তা, রাজনৈতিক চিন্তা, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে তিনি জানিয়ে গেছেন তার বহুমাত্রিক দ্যুতিময় প্রতিভা ও কৃতিত্বের জগৎ সম্পর্কে। মৃত্যুকে পরাজিত করে জীবনই জেগে থাক জিয়ার চার পাশ ঘিরে। এমনকি ব্যক্তিক মৃত্যুতে অতিক্রমী তার কর্ম কীর্তি ও চিরঞ্জীব সত্তা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হোক সবার সামনে, বিশ্বভূবন জুড়ে। যে স্বীকৃতির প্রতিধ্বনি তিনি পেয়েছেন জগৎ থেকে তা এখন স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনালি পাতায়। চলবে....
আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জিয়াউর রহমান। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি পালন করেন নিয়ামকের ভূমিকা, ঘোষণা করেন উদার, মধ্যেপন্থি ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক সুস্পষ্ট ভিশন; কৃষি, শিল্প ও জনশক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যান তার ভিশন নিয়ে। যোগ্যতা, শ্রম ও একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের মেল বন্ধনে তিনি সব বিঘেœর প্রাচীরকে চূর্ণ করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শীর্ষতম বিন্দুতে। জনপ্রিয়তা আর জিয়া পরিণত হয়েছিলেন এক ও অভিন্ন সত্তায়। অনৈক্য ও বিভাজনের কঠিন বৃত্ত থেকে তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বের করে এনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অঙ্কন করেছেন নিজের সাফল্য চিহ্ন। দর্শন চিন্তা, সাংগঠনিক চিন্তা, রাজনৈতিক চিন্তা, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে জিয়া সৃষ্টি করেছেন এক অভাবনীয় ইতিহাস। তার উদার, মধ্যেপন্থি ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা মানুষ আজ হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে। কেননা উগ্র, প্রতিহিংসা ও বিভেদ-বিভক্তির রাজনীতিতে জ্বলছে বাংলাদেশ, বিপন্ন মানবতা; আক্রান্ত হচ্ছে ধর্ম ও ধর্মীয় উপাসনালয়। বাংলাদেশে ইসলাম, সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপর এক সঙ্গে আঘাত এসেছে, যা অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি।
বলাবাহুল্য, সত্তরের দশকের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিদের উগ্র রাজনীতি বাংলাদেশকে সব দিক দিয়ে বিপন্ন করেছিল, দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল; মানুষ তখন বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল; দেশের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছিল অনিবার্য শূন্যতা, ঠিক এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী দর্শনের ভিত্তিতে জন্ম দেন বিএনপির। তিনি মানুষকে বুঝাতে সক্ষম হন, বিএনপি একটি উদার ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল। ফলে মানুষ দলে দলে বিএনপিতে যোগ দেয়। একটি চেতনায় বলীয়ান হয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে বিএনপির উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে। খুব স্বল্প সময়েই বিএনপি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
জিয়াউর রহমানের উদার, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূত্র ধরেই বাংলাদেশ সামনে এগোতে থাকে। বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হয় মধ্যেপ্রাচ্য ও উইরোপ-আমেরিকার। উন্মুক্ত হয় ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যেপ্রাচ্যে জনশক্তি ও তৈরি পোশাক রফতানিসহ বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনার দ্বার। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হতে থাকে। এখন বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশকে মধ্যপন্থি রাজনৈতিক ধারায় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এই স্থান দখল করে নিয়েছে উগ্রপন্থি রাজনীতি। তাই বাংলাদেশে আজ শান্তি নেই, অশান্তির আগুনে বাংলাদেশ জ্বলছে; বাংলাদেশ সবদিক দিয়ে আজ নিচের দিকে যাচ্ছে। যেটুকু অগ্রগতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা ধরে রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চিত বিপর্যয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি জিয়াউর রহমান তার জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির সুফল জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর জন্য তিনি কোনো গণমাধ্যমের সাহায্য নেননি আর তখনকার সময়ে গণমাধ্যমের উপস্থিতিও ছিল সীমিত। টেলিভিশন বলতে ছিল শুধু বিটিবি। পত্রিকা ছিল মাত্র কয়েকটি। তারপরও জিয়াউর রহমানের একক প্রচেষ্টায় জাতীয়তাবাদী ও মধ্যেপন্থি রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল দেশজুড়ে, যা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতির মূলস্রোতে পরিণত হয়; একটি প্রজন্ম জাতীয়তাবাদী ও মধ্যেপন্থি রাজনীতির ধারায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। ফলে আশির দশকে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয়তাবাদী ও মধ্যমন্থি রাজনীতি। তাতে জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির একটা অগতিরুদ্ধ নেতৃত্ব তৈরি হয়, যা ১৯৯০-এর দশকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়।
কিন্তু ’৯০-এর দশকের পরের প্রজন্ম অর্থাৎ আজকে যাদের বয়স বিশ থেকে পঁচিশ, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির বিকাশ ঘটেনি। রাজনীতিহীন, আদর্শহীন এক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশে; প্রতিবাদী কোনো চেতনা তাদের মধ্যে নেই। দেশে দুর্নীতি-দুঃশাসনের জয়জয়কার চলছে, লুট হচ্ছে শেয়ার মার্কেট ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। দেশ থেকে অবাধে পাচার হচ্ছে সম্পদ। শীর্ষ রাজনীতিকদের পাইকারি হারে জেলে নেয়া হচ্ছে, প্রধান রাজনৈতিক দলের কার্যালয় তছনছ করা হচ্ছে; বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে, কিন্তু রাজপথে কোনো প্রতিবাদ নেই। নেতাকর্মীশূন্য রাজপথ। এমন হলো কেন? এর কারণ কী? এটি খতিয়ে দেখা এখন জরুরি।
যোগ্যতা, শ্রম ও একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের মেলবন্ধনে সব বিঘেœর প্রাচীরকে চূর্ণ করে শেষ পর্যন্ত জিয়া পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শীর্ষতম বিন্দুতে। জনপ্রিয়তা আর জিয়া পরিণত হয়েছিলেন এক ও অভিন্ন সত্তায়। অনৈক্য ও বিভাজনের কঠিন বৃত্ত থেকে তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বের করে এনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অঙ্কন করেছেন নিজের সাফল্য চিহ্ন। দর্শন চিন্তা, সাংগঠনিক চিন্তা, রাজনৈতিক চিন্তা, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে তিনি জানিয়ে গেছেন তার বহুমাত্রিক দ্যুতিময় প্রতিভা ও কৃতিত্বের জগৎ সম্পর্কে। মৃত্যুকে পরাজিত করে জীবনই জেগে থাক জিয়ার চার পাশ ঘিরে। এমনকি ব্যক্তিক মৃত্যুতে অতিক্রমী তার কর্ম কীর্তি ও চিরঞ্জীব সত্তা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হোক সবার সামনে, বিশ্বভূবন জুড়ে। যে স্বীকৃতির প্রতিধ্বনি তিনি পেয়েছেন জগৎ থেকে তা এখন স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনালি পাতায়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।