Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুবিধা অব্যাহত চায় বাংলাদেশ

এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ

হাসান সোহেল; নিউ ইয়র্ক থেকে | প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম | আপডেট : ১২:১০ এএম, ১৮ এপ্রিল, ২০১৯

কেপ ভার্দে ২০০৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পর বেশ বিপাকেই পড়ে গেছে। আফ্রিকার এই দেশটির বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধাও হারিয়েছে দেশটি। আর এর ধারাবাহিকতায় দেশটির অর্থনীতি এখন টালমাটাল অবস্থা। কেপ ভার্দের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশের যাতে না হয়; সেজন্য আগাম সতকর্তা অবলম্বন করেছে সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এরই অংশ হিসেবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) চতুর্থ ‘উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন’ (এফএফডি) ফোরামের অধিবেশনে বাংলাদেশের তরফ থেকে উন্নত বিশ্বের কাছে জোর দাবি জানানো হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার পরও যাতে বাংলাদেশের জন্য সব ধরনের সুবিধা অব্যাহত থাকে। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের বছর পর্যন্ত অর্থ্যাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত সব ধরনের সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরও সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনে বিকল্প কর্মপন্থা তৈরি করার দাবি জানানো হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
আজ দুপুরে নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ প্লাজার মিলেনিয়াম হিল্টনে ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাঠামো ও এসডিজি বাস্তবায়ন’ শিরোনামে একটি সেমিনারের আয়োজন করে যৌথভাবে বাংলাদেশ, কেপ ভার্দে স্থায়ী মিশন, অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভোলপমেন্ট (ওইসিডি) এবং ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড ডেভোলপমেন্ট (আঙ্কটার্ড)। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন জাতিসংঘে নিযুক্ত কেপ ভার্দের স্থায়ী প্রতিনিধি জোসে লুইস ফিয়ালহো রোচা, আঙ্কটার্ডের মহা-সচিব মুখিসা কিটুয়ি, ওইসিডি’র পরিচালক জর্জ মরিরা দ্য সিলভা এবং জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভোলপমেন্ট পলিসি’র প্রধান রোনাল্ড মোলেরাস।
মূল প্রবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলো থেকে কম সুদে ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। উন্নত দেশ থেকে সরকারিভাবে দেওয়া সহযোগিতা (ওডিএ) কমে যাবে। অথচ বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। উন্নত বিশ্ব থেকে সহযোগিতা কমে গেলে বাংলাদেশের জন্য এসডিজি বাস্তবায়ন বেশ কঠিনই হবে। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও আমাদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা জরুরি। সেমিনার শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্বে আমরা এখন যেসব বাণিজ্য সুবিধা পাই, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে আমরা সেসব সুবিধা হারাবো। এসব সুবিধা যাতে আমাদের জন্য অব্যাহত থাকে, আমরা সে অনুরোধ করেছি। তারা বিষয়গুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখতে বিকল্প কোনো নীতি কৌশল প্রণয়ন করা যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছে। নজিবুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ এমনতিই ঝুঁকিতে। তার ওপর এসব সুবিধা হারালে আমরা সমস্যার মধ্যে পড়ে যাব। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়ে কেপ ভার্দের পরিস্থিতি ভালো নয়।
আজকের সেমিনারে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে বড় আঘাত আসবে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে জিএসপি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে রপ্তানিতে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার যে সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশ, সেটি আর থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি করা পণ্যে অতিরিক্ত ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক বসবে। এতে বছরে রপ্তানি কমবে ২৭০ কোটি ডলার বা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এখন যেমন মেধাস্বত্বের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করে সেটি বিদেশে রপ্তানি করে, উন্নয়নশীল দেশ হলে সে সুবিধা আর থাকবে না। ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে বাংলাদেশও রপ্তানি শুল্কমুক্ত সুবিধা, কম সুদে ঋণসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা হারাবে।
ইআরডি সচিব মনোয়ার আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, একটা দেশ বহু কষ্ট করে সব ধরনের যোগ্যতা অর্জনের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়। তারপরদিন বলে দেওয়া হলো, ওই দেশের জন্য সব সুযোগ সুবিধা বন্ধ। এটা অন্যায্য। পুুরস্কারের বদলে শাস্তি। ওই দেশটি কি করবে। কেপ ভার্দেকে এখন কেউ সহযোগিতা করছে না। আমরা উন্নত বিশ্বের কাছে বলেছি, আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরও যাতে আমাদের জন্য বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা অব্যাহত থাকে। যাতে করে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি আমরা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি। এজন্য বিশ্বব্যাপী আমরা জনমত গড়ে তুলছি। প্রয়োজনে এসব সুবিধা অব্যাহত রাখতে বিকল্প নীতি কৌশল প্রণয়ন করার অনুরোধ করেছি। সেমিনারে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, নিউ ইয়র্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের ইকোনমিক মিনিস্টার ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব আনোয়ার হোসেনসহ অন্যরা।
কেপ ভার্দের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জোসে লুইস ফিয়ালহো রোচা তার দেশের উত্তরণ সময়কালের এবং উত্তরণ পরবর্তী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। নিজ দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি সদ্য উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর উত্তরণ পথ মসৃণ এবং টেকসই করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পদক্ষেপসমূহ অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ, উন্নয়ন অংশীদার ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমন্বয়ে উত্তরণ সময়ের জন্য একটি ‘ট্রানজিশন সাপোর্ট টিম’ প্রণয়নের কথাও তুলে ধরেন তিনি। আঙ্কটার্ডের মহা-সচিব মুখিসা কিটুয়ি উত্তরণ টেকসই করতে ডিজিটাল ইকোনমি সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেন। দেশগুলোর ই-কর্মাসের প্রস্তুতি, সক্ষমতা বিনির্মাণের উপর জোর দেন তিনি। টেকসই উন্নয়ন অর্থায়নে জাতিসংঘ উন্নয়ন ব্যবস্থা আরও কিভাবে ভালো সমর্থন যোগাতে পারে তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি’র প্রধান রোনাল্ড মোলেরাস উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর জন্য একটি কনসালটেটিভ মেকানিজম তৈরি করার কথা উল্লেখ করেন। এই কনসালটেটিভ মেকানিজম সংশিষ্ট দেশ জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাঠামোর সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। যা ওই দেশগুলোর উন্নয়ন চাহিদা নিরূপন করে এর সঠিক তথ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরবে। দেশগুলোর উত্তরণকালীন সুবিধাদি যাতে আরও বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আসন্ন ডাব্লিউটিওর সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে মর্মে উল্লেখ করেন রোনাল্ড মোলেরাস।
এলডিসিদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে ওডিএ প্রদানকারী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি’র পরিচালক জর্জ মরিরা দ্য সিলভা বলেন, উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে এই ধারার পরিবর্তন দরকার এবং উত্তরণশীল দেশগুলোকে অবশ্যই সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি ২০৩০ এর বাস্তবায়ন এবং এলডিসি থেকে উত্তরণসহ সামগ্রিক উন্নয়ন অভিযাত্রায় যাতে কোন দেশ যাতে পিছিয়ে না থাকে সে লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্যানেল আলোচকরা। উল্লেখ্য, গত ১৫ এপ্রিল শুরু হওয়া এফএফডির ৪র্থ ফোরাম আগামী ১৮ এপ্রিল শেষ হবে।

 



 

Show all comments
  • sharul islam ১৮ এপ্রিল, ২০১৯, ৯:৫২ এএম says : 0
    good comment
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ