Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইতিহাসের বয়স দেড় শতাব্দী

বিশ্বের ২৫ দেশে শ্রীমদ্দির বাঁশিতে সুর উঠে

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম


গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা অনেক জনপ্রিয় বাংলা গানের একটি ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’। গানের বাঁশি শব্দের সঙ্গে মিশে আছে কুমিল্লার একটি গ্রামের নাম। সেই গ্রামে সুরের যন্ত্র তৈরির ইতিহাসের বয়স দেড় শতাব্দী। তারপরও অনেকের ধারণা, গৌরিপ্রসন্ন এই ইতিহাস জানার পরই ওই গান লিখেছিলেন।
এক কিংবা দুই বছরের কথা নয়। এটি দীর্ঘ ১৫০ বছরের ধারাবাহিকতা। এর ইতিহাস বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁশি। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে খ্যাতির জায়গাটি ধরে রেখেছে কুমিল্লার শ্রীমদ্দির বাঁশি।
পূর্বপুরুষের পেশা বুকে ধারণ করে কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্রীমদ্দি গ্রামের শতাধিক পরিবারের নারী-পুরুষের হাতে তৈরি বাঁশিতে সুর তুলছে বর্হিবিশ্বের বংশীবাদকরা। বাঁশিতে জীবিকা নির্বাহ ঘিরে ছোট্ট এই গ্রামটিতে সনাতন সম্প্রদায় ও মুসলিম শত পরিবারের সহাবস্থান অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে যুগ যুগ ধরে সুরের মায়াজালে আবদ্ধ রেখেছে। হোমনা উপজেলা সদর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণে সবুজ গাছপালা ঘেরা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম শ্রীমদ্দি। স্থানীয়দের কেউ বলেন বাঁশির গ্রাম। কেউবা বলেন বলে বাঁশি পাড়া। গ্রামের অন্তত একশো পরিবারের সবাই বাঁশিতেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিশুদেরও স্কুল ছুটির পর বা বন্ধের দিনে বাঁশি তৈরিতে সময় কাটে।
গ্রামে পা রাখলে চোখে পড়বে নানা বয়সের মানুষ বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত। সারা বছরই ওরা বাঁশি তৈরিতে মগ্ন থাকেন। তবে বাঙলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ ঘিরে ব্যস্ততা বাড়ে শ্রীমদ্দির বাঁশি কারিগরদের। নানা আকারের বাহারি নামের সুরেলা বাঁশি তৈরির কাজ চলছে অবিরাম। আর কটা দিন পরই বাংলা নববর্ষ। তাই যেনো বিশ্রামের ফুসরত নেই বাঁশি কারিগরদের। পহেলা বৈশাখে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে মেলায় বাঁশির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
বর্তমানে বাঁশি তৈরির হিড়িক পড়েছে শ্রীমদ্দি গ্রামে। বিভিন্ন স্থানের বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দির কালীবাড়ীর মেলা, কচুয়ার সাচারের রথমেলা, ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতুলীর লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা, নাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়ার লালন মেলা ও গাজীপুরে মৌসুমি মেলায় শ্রীমদ্দির বাঁশি বিক্রি স্থান পেয়ে থাকে।
বাঁশি তৈরি করেই শ্রীমদ্দি গ্রামের অনেকেই স্বাবলম্বী। কেবল তাই নয়, এখান থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকার বাঁশি বিদেশে রফতানিও হচ্ছে। এ কারণেই দেশের গন্ডি ছাপিয়ে বিশ্বপরিমন্ডলে বাঁশির গ্রাম হিসেবে কুমিল্লার শ্রীমদ্দি পরিচিতি পেয়েছে। শ্রীমদ্দির বাঁশির ইতিহাস জানা যায় সেখানকার বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে। প্রায় ১৫০ বছর আগে কোকিল দাশ বৈরাগী ও দীনবন্ধু নামের দুই ব্যক্তির হাত ধরে এ গ্রামে বাঁশি তৈরির গোড়াপত্তন ঘটে।
বর্তমান ভারতের অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ছিল ওই দুইজনের। সেখান থেকে দেশে ফিরে শ্রীমদ্দিতে বাঁশি তৈরি শুরু করেন তারা। সেই যে শুরু, তার ধারাববাহিকতা ধরে রেখেছেন শ্রীমদ্দি গ্রামের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
শ্রীমদ্দির বাঁশির সাতকাহন নিয়ে কথা হয় লিটন পাল, যতীন্দ্র, রীনা রানী, ইব্রাহিম, কামাল হোসেন, শওকত, ও খালেকের সাথে। তারা জানান, ঢাকার চকবাজার হয়ে শ্রীমদ্দির বাঁশি পৌঁছে যায় সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্র্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে।
শ্রীমদ্দিতে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবার বাপদাদা-বড়দাদার আমল থেকে বাঁশি তৈরির কাজ করছেন। চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড ও মিরসরাই থেকে মুলি বাঁশ কিনে আনা হয়। পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাঁশ কেটে টুকরো করা হয়। টুকরোগুলো রোদে শুকিয়ে ফিনিশ করে কয়লা পুড়িয়ে লোহা গরম করে মাপ অনুযায়ী বাঁশে ছিদ্র করা হয়। এরপর মান্দাল কাঠ দিয়ে কড়ি তৈরি করে বাঁশের মাথায় আটকে দেয়া হয়। বাঁশের কভারে রঙ করে বাজারজাত করা হয়।
প্রায় ১৫ ধরনের ছোট বড় বাঁশি তৈরি হয় শ্রীমদ্দিতে। এরমধ্যে আঁড়, মোহন, ভীন, নাগিন, বাবু, বেলুন, ক্লাসিক্যাল বাঁশি রয়েছে। প্রকারভেদে প্রতিটি বাঁশি ১০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে লম্বা, মোটা নিখুঁত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে।
এছাড়াও বিভিন্ন মেলায় মুখ বাঁশি, ক্যালেনের বাঁশি, পাখি বাঁশি মিলে ২ থেকে ৫ টাকায়। শ্রীমদ্দির বাঁশির কারিগররা জানান, বর্তমানে বাঁশ, রঙ, কয়লা ও স্পিরিটসহ বাঁশি তৈরির সব উপকরণের দামই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাঁশির দাম বাড়ছে না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজশর্তে ঋন পেলে শ্রীমদ্দির বাঁশি শিল্পের আরও প্রসার ঘটবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ