Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাবিতে ছাত্রলীগের হাতে নারী শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত!

নুর হোসেন ইমন | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে গত সোমবার রাতে শিক্ষার্থীকে মেরে রক্তাক্ত করার প্রতিবাদে প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরা। ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শামসুন্নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিসহ নারী শিক্ষার্থীদের উপর ডিম ছোঁড়ে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় তার গায়ে হাত দেয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি। ছাত্রলীগের হাতে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ছাত্র ফেডারেশনের শাখা সভাপতি উম্মে হাবীবা বেনজির, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহরাব হাসান, হাবিবুল্লাহ বেলালীসহ কয়েকজন। একই সময় ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরসহ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্য সদস্যদের ২ ঘন্টা হলে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হলে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে সাড়ে ৭টার দিকে ভিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। রাত সাড়ে ৮টায় প্রতিবেদন লেখার পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত আছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মো. ফরিদ হাসানকে ছাত্রলীগের মারধরের প্রতিবাদ জানাতে গতকাল মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটার দিকে নিয়ে ভিপি নুর এসএম হলে প্রবেশ করেন। এসময় তার সাথে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। হলে প্রবেশ করার পরপরই হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপসের নেতৃত্বে তাদের অবরুদ্ধ করা হয়। এসময় নুরুল হক নুরকে ধাক্কা দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ঘটনায় উপস্থিত সামসুন্নাহার হলের ভিপি তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, আমরা হল প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীকে মারধরের প্রতিবাদে স্মারকলিপি দিতে আসলে তারা আমার গায়ে হাত দেয়। এসময় আমাদের সবাইকে ডিম ছোঁড়তে থাকে ও ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর ও সমাজেসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। অরণি সেমন্তি খান বলেন, হলে গেলে আমরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হই। আমাকে লাথি মারা হয়েছে এবং আমার গায়ে ঘুঁষি মারা হয়েছে এবং বিভিন্ন রকমের আজেবাজে কথা বলা হয় আমাদের। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে হল প্রভোস্ট প্রফেসর মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সাতটার দিকে নুর ও অন্যান্যদের নিয়ে হল থেকে বের হয়ে আসেন তিনি। হামলার বিষয়ে নুরুল হক নুর বলেন, ফরিদের উপর হামলার প্রতিবাদে প্রক্টরকে প্রতিবাদ লিপি দিয়ে আমরা হল প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিতে যাই। এসময় ছাত্রলীগের হল কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। তারা আমাদের আটকে রেখে। প্রভোস্ট স্যার যখন আমাদের নিয়ে বের হয়ে আসে তখন তারা আমাদের লাঞ্চিত করে। ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে নির্বাচিত হল সংসদের ভিপি কামাল হোসেন এসব ঘটনা মিথ্যা অভিযোগ করে বলেন, মাদক ব্যবসায়ীকে বাঁচানোর জন্য তিনি (নুর) হলে এলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ডিম নিক্ষেপ করেছে।
এরআগে শিক্ষার্থীর উপর হামলার প্রতিবাদে বিকাল ৪টায় টিএসসির সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধনে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরসহ আরও উপস্থিত ছিলেন অরণী সেমন্তি খান, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজীর, কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খাঁন, সোহরাব হাসানসহ অনেকে। নুরুল হক নুর হামলার সঙ্গে যারা জড়িতদের তিন দিনের মধ্যে সিন্ডিকেট মিটিং ডেকে বহিষ্কার করার দাবি জানান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা অনেক নির্যাতিত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটা অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফরিদের উপর হামলাকারীদের যদি বহিষ্কার করা না হয়, তিনদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু সন্ত্রাসীর পৃষ্ঠপোষকতা করে। বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকার পরেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। আজ ছাত্ররা তাদের নিজেদের অধিকার খুঁজে নেওয়ার জন্য সোচ্চার হয়েছে। ছাত্রদের অধিকার যদি লঙ্ঘিত হয় তাহলে ছাত্ররা যা করার তা করবে। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক পদক্ষিণ করে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যান তারা।
এর আগে সোমবার রাতে ছাত্রলীগের বিপরীতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদে জিএস প্রার্থী হওয়া এক শিক্ষার্থীকে হল ছাড়া করতে মেরে রক্তাক্ত করার অভিযোগ উঠে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। মারধরে আহত ফরিদ হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। আহত হয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। মারধরে রক্তাক্ত শিক্ষার্থীর মাথায় ৩২টি সিলাই দেয়া হয়েছে। একই পদে হল সংসদে ছাত্রলীগ থেকে বিজয়ী হওয়া জুলিয়াস সিজার ও হল শাখা ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে তার উপর হামলা হয় বলে জানা যায়। আহত শিক্ষার্থী ফরিদের অভিযোগ, সোমবার রাত সাড়ে ১১টার হলে নিজের কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। এসময় কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা তার কক্ষে গিয়ে টানাহেঁচড়া করে তাকে হলের ডাইনিং কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে জুলিয়াস সিজার, হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান পিকুলসহ কয়েকজন তাকে হলে থাকার সহস কে দিয়েছে জিঙ্গেস করে মারধর করা শুরু করে। তার অভিযোগ, হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হলে ছাত্রলীগ নেতারা বিভিন্নভাবে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করতে বলে। কিন্তু এর পরেও প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করলে তারা আমার কক্ষে ইয়াবা ঢুকিয়ে আমাকে হল থেকে বের করে দেয়। পরে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। তিনি বলেন, সোমবার রাতে ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে রড, লাঠি দিয়ে মারধর করে রক্তাক্ত করে। তারা আমাকে জিঙ্গেস করে আমি কেন প্রার্থী হই, হলে থাকি কেন?
মারধরের অভিযোগে অভিযুক্ত হল সংসদের জিএস জুলিয়াস সিজার বলেন, ফরিদ মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত। সোমবার রাতে হল সংসদের সভায় মাদক ও ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গৃহীত হয়েছে। তাই ফরিদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতির প্রথম প্রয়োগ হয়েছে। তবে তাকে কোনো ধরনের মারধর করা হয়নি, ভদ্রভাবে হল ছাড়তে বলা হয়েছে। উত্তেজিত হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে মারধর করে থাকলে সেটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিষয়। এসএম হলের প্রভোস্ট প্রফেসর মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার এ বিষয়ে বলেন, ফরিদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই করতে হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনার বিচার চেয়ে ফরিদ হাসানের পক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. এ কে এম গোলাম রব্বানীর কাছে মঙ্গলবার দুপুরে ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচন করা প্রার্থী অরণি সেমন্তি খানসহ কয়েকজন একটি দরখাস্ত তুলে দেন। ফরিদ হাসান অভিযোগ পত্রে জড়িতদের যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি করে ৫জন হামলাকারীর নাম সংযুক্ত করেন। তারা হলেন- ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও হল ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ওয়াসিফ হাসান পিয়াস, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র ও হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল হোসেন, ফার্সি বিভাগের মুজাহিদ, সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ও হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সানাউল্লাহ সায়েম এবং পরিসংখ্যান বিভাগের সাব্বির। এরা সবাই ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। প্রক্টর বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর এ কে এম গোলাম রব্বানী এ বিষয়ে বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। হল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ