পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
নাঈম ইসলাম এক বীরত্বগাঁথার নাম। গুলশান কড়াইল বস্তির ১০ বছর বয়সের এই শিশুর নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘শিশু স্পাইডারম্যান’, খুদে ‘হিরো’ ‘পাইপ বয়’ উপাধি। বনানী এফআর টাওয়ারে আগুন নেভানোর সময় দায়িত্ববোধ থেকেই ফায়ার সার্ভিসের ফুটো পাইপ চেপে ধরে রেখে নাঈম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; তাতে সে সবার চোখে হিরো। নাঈমের বীরত্বগাঁথার গল্প নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে উচ্ছ্বাস তর্ক-বিতর্ক হৈচৈ। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের আলোর ঝলকানিতে টিভি নাটকের ভিলেন শাহরিয়ার নাজিম জয় ‘বিষ্ঠা’ ছিঁটিয়ে জাতির অহংবোধের ওপর আঘাত করেন। ক্ষমতাসীনদের খুশি করে কিছু উচ্ছিষ্ঠ পাওয়ার প্রত্যাশায় সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক চিন্তা থেকে চাটুকার খলনায়ক জয়ের ইতরামী অবুঝ শিশু নাঈম ইসলামের অর্জন ভূলুণ্ঠিত। দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে নাঈমের মতো শিশুরা যখন দায়িত্ববোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বড়দের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় হচ্ছেন; তখন এক সময়ের নাটকের তোতলা ভিলেন হালে টিভি উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয়েরক কূকর্মে দেশের নাঈম ইসলামরা হতোদ্যম হয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। এই শাহরিয়ার জয়েরা দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে জাতির ওপর বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে। এখন হালুয়া-রুটির প্রত্যাশায় রাজনীতিকে কলুষিত করার চেষ্টা করছেন? নাঈম ইসলামের মহৎপ্রাণে অপরাজনীতি টেনে আনার কি রহস্য?
২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি স্টেশনের পূর্বে ঝিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র শিহাব ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লিটন উপস্থিত বুদ্ধিতে একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঠেকিয়েছিল। বিচ্ছিন্ন রেল সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে দুই শিশুর লাল জামা ওঠানোয় ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৩১টি ওয়াগন দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পায়। দুই শিশুর ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু তাদের পুরস্কৃত করা হয়। দেশ বিদেশে শিহাব-লিটনকে নিয়ে বীরত্বের কাহিনী লেখা হয়। এর আগে কুমিল্লায় এক শিশু দুর্ঘটনা থেকে ট্রেনের হাজার যাত্রীকে রক্ষা করে পুরস্কৃতি হন। তেমনি বীরত্বের ঘটনায় ঘটিয়েছে ২৮ মার্চ বনানী এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের সময় নাঈম। ব্র্যাক আনন্দ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র নাঈম বাবা-মা আর ছোট বোনের সঙ্গে করাইল বস্তিতে থাকেন। মা পরের বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করেন; বাবা বিক্রি করেন ডাব।
বনানীর ২৩ তলা এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর সবাই যখন আগুনের লেলিহান শিখা দেখে হায়হায় করেন; অনেকেই ভিড় করে উদ্ধারকর্মীদের সমস্যার সৃষ্টি করেন; তখন নাঈম বীরত্বের পরিচয় দেন। ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোয় যুদ্ধে পাইপের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ছিল। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে নাঈম ফুটা পাইপ চেপে ধরে পানি পড়া করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাইপ চেয়ে ধরে থাকেন। একটি শিশুর এই সাহসী ভূমিকায় সবাই উদ্বেলিত। চারিদিকে যখন মানবিকতার অধঃপতন, নীতি-নৈতিকতার উপেক্ষিত; তখন নাঈমের পাইপ চেয়ে ধরার কাজ ছোট্ট হলেও দেশের উদ্বিগ্ন মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। মিডিয়ায় এই খবর পড়ে আমেরিকা প্রবাসী ওমর ফারুক সামি ঘোষণা দেন তিনি বস্তির ছেলে নাঈমকে ৫ হাজার ডলার (৪ লাখ টাকা) অনুদান দেবেন এবং লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবেন। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী ওমর ফারুক সামি বলেন, ‘আমি নাঈমের কাজে খুবই খুশি হয়েছি। নাঈম খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে, সে পুলিশ অফিসার হতে চায়। তার ইচ্ছেপূরণ করতে এখন থেকে তার পড়ালেখার দায়িত্ব নিলাম’। অতঃপর টিভি নাটকের স্কান্ডালবয় হালে এক টিভি উপস্থাপক শাহরিয়ার জয়ের একটি শো টিভিতে প্রচারের পরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। সেই প্রবাসী নাঈমকে ৫ হাজার ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থাগিত করেন। কেন এমন হলো?
নাঈম ইসলামের সাহসিকতা নিয়ে সারাদেশে হৈচৈ পড়ে যাওয়ায় টিভি উপস্থাপক ও অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় বিস্ময়বালক নাঈমের একান্ত সাক্ষাৎকার নেন। এ সময় নাঈমের সঙ্গে তার বাবা-মা ছিলেন। মূলত ধান্ধা থেকেই তিনি এই কাজ করেন। অনুষ্ঠানে তিনি জানতে চান নাঈম পুরস্কারের ৫ হাজার ডলার নেবে কিনা? আর নিলেও সেই টাকা কিসে খরচ করবে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নে জবাবে নাঈম ইসলাম জানায়, সেই টাকাগুলো সে এতিমখানার অনাথ শিশুদের জন্য দান করে দিতে চায়। ছেলের এ জবাবে সায় দেন তার মা-বাবা। এতিমখানায় কেন টাকা দিতে চায় এমন প্রশ্নের উত্তরে নাঈম জানায়, কয়েক বছর আগে খালেদা জিয়া এতিমের টাকা লুট করে খেয়েছেন। তাই এই টাকা সে এতিমদের দিতে চায়। এই অনুষ্ঠান দেখেই সর্বত্রই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এখানে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টেনে আনা হচ্ছে কেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বøগ, ফেসবুক, টুইটারে তীব্র প্রতিবাদ হয়। এটা দেখে আমেরিকা প্রবাসী সেই ওমর ফারুক সামি ঘোষণা দেন, ‘এই ছেলে (নাঈম) তো রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। আমার কষ্টার্জিত টাকায় নোংরা রাজনীতি কেনো? আমি বলেছিলাম, পড়াশোনার জন্য টাকা দেব। রাজনৈতিক নোংরামি করতে হলে নিজের টাকায় করুক। এতিমখানায়ই যদি টাকা দিতে হয় তাহলে তো আমি নিজেই তা দিতে পারি’।
শিশু নাঈম ইসলাম ও শাহরিয়ার নাজিম জয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়; তখন প্রকৃত ঘটনা খুলে বলেন শিশু নাঈম। সে জানায়, উপস্থাপক তাকে শিখিয়ে দেয়ায় খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন এ জন্য এতিমখানায় টাকা দিতে চান বলেছেন। নিজের থেকে বলেননি। আমিরুল মোমিনিন মানিক নামের এক সাংবাদিক শিশু নাঈমের সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। নাঈম ইসলামকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তোমার মা কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন, তোমার পড়াশোনার খরচ বহন করছেন, তোমার নিজের টাকা দরকার, তাহলে তুমি কেন সে টাকা নিজে না রেখে এতিমদের দিয়ে দিতে চাও? এটা কী তোমার মনের কথা?’ শিশু নাঈমের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘না, এটা বলতে তারা শিখিয়ে দিয়েছিল।’ এরপর প্রশ্নকর্তা বলেন, ‘যিনি তোমাকে টাকা দিতে চেয়েছিলেন তিনি এখন বলেছেন আর টাকা দেবেন না। তুমি কী টাকাটা চাও?’ নাঈমের জবাব, ‘আমি ওই কথা না বুঝে বলেছি, আমি টাকা চাই, আমার পড়াশোনার জন্য টাকা চাই।’ একই প্রশ্ন করা হয় নাঈমের মাকে। তিনি বলেন, ‘নাঈম ছোট মানুষ, তাই না বুঝে এসব বলেছে। আমি গরীব মানুষ, টাকা আমারই দরকার। টাকা অন্যদের দিয়ে দিলে আমার নাঈমকে আমি কীভাবে মানুষ করব!’ প্রশ্ন হলো ছোট্ট একটি শিশুকে নিয়ে কেন এই অপকর্ম?
দেশে রাজনৈতিক বিভাজন ও অপরাজনীতির কারণে সমাজে ভালো কাজ প্রায় উঠে গেছে। ভোটের অধিকার হারানো মানুষ পোকামাকড়ের মতোই বসবাস করছে। চোখের সামনে কেউ বিপদে পড়লে ‘পাছে কোন বিপদ আসে’ ভয়ে মানুষ সহায়তার বদলে এড়িয়ে যায়। সেখানে রাজশাহীর শিহাব, লিটন ও কড়াইল বস্তির নাঈম ইসলামের মতো অবুঝ শিশুরা কিছু কাজ করে মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটেন; সমাজের বিবেকহীন দলবাজ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিতদের বিবেকে নাড়া দেন। সেটা নিয়েও দলবাজী! ধান্দা!! খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিনেতা এই শাহরিয়ার নাজিম জয় তোতলানোয় নাটকে কেউ নেয় না। এজন্য এক সময় বিভিন্ন টিভি নায়িকার সঙ্গে নিজের স্কান্ডল ছড়িয়ে বিনোদন সাংবাদিকদের দিয়ে নিউজ করে আলোচনায় থাকতেন। কিছুদিন আগেও টিভিকে এক লাইভ অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় নায়িকা মৌসুমীকে প্রশ্ন করেন ‘আপনার স্বামীর মৃত্যু হলে আমাকে বিয়ে করবেন কিনা; আগাম কথা দ্যান?’ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় ওই নায়িকা। পরে অবশ্য প্রকাশ্যেই উপস্থাপন ক্ষমা চান। কিছুদিন পর ওই অনুষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র মরহুম হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওনকে অনুষ্ঠানে এনে একই ধরনের প্রশ্ন করে অতিথিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন। যথারীতি ক্ষমা চেয়ে নেন।
এদিকে শাহরিয়ার নাজিম জয়ে মুখোশ খুলে দিয়েছেন নাঈমের মা নাজমা বেগম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয়ের সাক্ষাৎকারে নাঈমের দেয়া এ বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাচ্ছি। কথাটি শিশু নাঈমকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। যখন শাহরিয়ার নাজিম জয় নাঈমকে বাসা থেকে তার স্টুডিওতে নিয়ে যায়, তখন আমি ছিলাম না। নাঈমকে একাই নিয়ে গিয়েছিল। আমি এর দেড় ঘণ্টা পরে সেখানে গিয়েছি। ওই দিন ইন্টারভিউয়ের সময় শাহরিয়ার নাজিম জয় আমার ছেলের হাতে একটা খাম দিয়েছিল। আমি পরে বাসায় এসে খুলে দেখি ২ হাজার টাকা। দয়া করে খালেদা জিয়ার ব্যাপারটার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ওই নেত্রীর (খালেদা জিয়া) কাছে আমি, আমার ছেলের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আমার স্বামী আমাদের সাথে থাকেন না। আমি আমার ছেলে ও ছোট একটা মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবন চালাই। আমি বাসা বাড়িতে কাজ করে খাই। আমি চাই না, আমার ছেলে কোনো বিপদে পড়ুক’।
শাহরিয়ার নাজিম জয় দাবি করেছেন, তিনি নাঈমকে কোনো কথা শিখিয়ে দেননি। সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি নাঈমকে কোনো কথা শিখিয়ে দেইনি। এমন কি আমার ইউনিটের কেউই তাকে, কোন ধরনের কথা শিখিয়ে দেয়নি। এতটুকু বাচ্চাকে আমার শিখিয়ে দেয়ার কিছু নেই। সে নিজে কোথাও থেকে শিখে এসেছে কি-না আমি বলতে পারব না। এ ঘটনার পর দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন নম্বরের মাধ্যমে আমাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এরইমধ্যে আমার ফেসবুক আইডিও হ্যাক করা হয়েছে। তাই জিডি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য নাঈমকে ২ হাজার টাকা দেয়ার ব্যাপারে কিছুই বলেননি।
প্রশ্ন হলো শাহরিয়ার নাজিম জয়ের মতো নাটকের তথাকথিত নায়ককের ভিলেনি আচরণে বস্তির নাঈম ইসলাম কি প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্ছিত হতে হবে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।