Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হারিয়ে যাচ্ছে চাটগাঁর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বেপরোয়া দখল পাহাড় নিধন : অপরিকল্পিত উন্নয়ন-নগরায়ন

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

হারিয়ে যাচ্ছে চাটগাঁর প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্য। ইট-পাথরের স্থাপনায় চাপা পড়ছে অপরূপ সৌন্দর্য। নির্বিচারে পাহাড় নিধন, খাল-নদী-ছরা দখল, অপরিকল্পিত নগরায়ন-উন্নয়ন, শিল্প কারখানার দূষণে চট্টগ্রামের পরিবেশ এখন বিপর্যস্ত। এরফলে বিকশিত হচ্ছে না অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প। অন্যদিকে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিবছর পানিবদ্ধতায় শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। আর পাহাড় ধসে ঘটছে ব্যাপক প্রাণহানি।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে ‘প্রাচ্যের রানী চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখেই শিল্পায়ন ও উন্নয়ন’ এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সমুদ্র বন্দর এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মতোই চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাগর-নদী-পাহাড় ঘেরা সেই দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রাখতেই হবে।’ তবে বাস্তবতা হলো চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় কোন উদ্যোগ নেই। বরং উন্নয়ন আর নগরায়নের নামে চলছে প্রকৃতি বিধ্বংসী কার্যক্রম। পাহাড়-নদী সুরক্ষার দায়িত্বে যারা তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে দূষণ আর দখলের অভিযোগ। পরিবেশ অধিদপ্তরও অনেকটা ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদারের ভ‚মিকায়।
বেপরোয়া দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে অসংখ্য খাল-ছরা। কেটে সাবাড় করা হয়েছে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়। এখনও চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন আর পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতায় চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী এবং প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদার এখন মরণদশা। খাল-পুকুর-ডোবা ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় স্থায়ী রূপ নেয় পানিবদ্ধতা। অন্যদিকে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকায় এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পাহাড় কেটেই সড়ক নির্মাণ করছে। ফৌজদারহাট থেকে নগরীর শেরশাহ পর্যন্ত মাত্র ছয় কিলোমিটার একটি সংযোগ সড়ক বানাতে গিয়ে ১০টি পাহাড় কেটে ফেলে সিডিএ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য টাইগারপাসের পাহাড় কাটা হবে এমন খবরে ইতোমধ্যে রাস্তায় নেমেছে পরিবেশবাদীরা। টাইগারপাসের সৌন্দর্য অক্ষু্ন্ন রাখার দাবিতে সম্প্রতি নগরীতে মানববন্ধন ও সমাবেশও হয়েছে। মহানগরীর ছোট-বড় অসংখ্যক পাহাড় নিধনের পর এখন চলছে জেলা পর্যায়ের পাহাড়-টিলা ধ্বংস। সীতাকুন্ডের সলিমপুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় আর বনজঙ্গল সাবার করে গড়ে উঠছে বসতি। বড় বড় শিল্প কারখানা মালিকরাও পাহাড় কাটছে। বিভিন্ন সময়ে পাহাড় ধ্বসে গণমৃত্যুর পর পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে সে মামলার তদন্ত বেশি দূর যায় না। পাহাড় কাটার সাথে জড়িতদের তালিকা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শিল্পবর্জ্য আর ইটের ভাটায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদী দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। কর্ণফুলীর তীরে কোটি কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। ৬০ লাখ মানুষের এই মহানগরীতে এখনও গড়ে উঠেনি স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা। প্রতিদিন লাখ লাখ টন বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে নদীতে। কল-কারখানার বর্জ্যওে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলীর পরিবেশ। মরণদশায় এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীও। বেসরকারি কল-কারখানার পাশাপাশি সরকারি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্যও গিয়ে পড়ছে হালদায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ হালদার জন্য মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব শেষ করা হচ্ছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম নেতা স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, পাহাড়-খাল-ছরা-জলাশয় দখল করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়নের ফলে চট্টগ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংস হতে চলেছে। ভারী বর্ষণ হলেই চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা হচ্ছে। নিয়মিত জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে বিশাল এলাকা। মানুষের সৃষ্টি এ দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।
স্থপতি মইনুল আহসান বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে উন্নয়ন আর নগরায়ন সম্ভব হলেও চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে হয়েছে তার উল্টো। পরিবেশের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিশাল সম্পদে পরিণত করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটা এখনি বন্ধ হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি উন্নয়ন কাজের জন্যও পাহাড় নিধন হচ্ছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তখাল-নদী ও পাহাড় সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ জরুরী উল্লেখ করে স্থপতি জেরিনা হোসেন ও মইনুল আহসান খান বলেন, এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে পাহাড়-নদী-খালসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা এখনও সম্ভব।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, পাহাড় নিধন প্রতিরোধ ও খাল-নালা-জলাশয় রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। বাইপাস সড়কের জন্য সিডিএ কর্তৃক ১০টি পাহাড় কাটার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ঘটনার পরপর তাদের ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হলে সিডিএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েই তারা এসব পাহাড় কেটেছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি এখনও নজরদারিতে রেখেছে বলে জানান তিনি। সৈকতের পরিবেশ ধ্বংস এবং কল-কারখানার বর্জ্য নিঃসরণ করে নদী দূষণের দায়েও কল-কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। উন্নয়ন প্রকল্পেও পরিবেশ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ