Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

জীবন বাঁচাতে রক্তদান!

চট্টগ্রামে চাহিদার পুরোটাই দিচ্ছেন তরুণেরা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ইব্রাহিম সোহাগ, ওমর ফারুক, মশিউর রহমান ও জসিম উদ্দিন। কারোও রক্তের প্রয়োজন হলেই এ চার বন্ধু ছুটে যান। সঙ্কটাপন্ন রোগীর জন্য রক্ত দেন। শুধু তারা নন তাদের অন্য বন্ধুরাও জীবন বাঁচাতে ছুটেন ব্লাড ব্যাংকে। রক্তের সম্পর্ক নেই এমন মানুষ কিংবা একেবারেই অপরিচিতদের প্রয়োজনেও তারা নিজের রক্ত দেন। এ যুবকদের মতো চট্টগ্রামে অনেকেই স্বেচ্ছায় রক্ত দিচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার আগ্রহ বাড়ছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫শ’ ব্যাগের মতো রক্তের প্রয়োজন। আর বছরে প্রয়োজন প্রায় দুই লাখ ব্যাগ। এর প্রায় পুরোটাই পূরণ করছেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা।
’৮০-এর দশকের শুরু থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় জরুরি প্রয়োজনে রক্ত দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে সন্ধানী। তাদের সে সচেতনতামূলক প্রচারণা এতোদিনে তারুণ্যের জাগরণ সৃষ্টি করেছে। এখন আরও অনেক সংগঠন স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ায় উদ্বুদ্ধ করছে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার উৎসাহ দিনে দিনে বাড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, একসময় পেশাদার রক্তদাতাদের উপরই নির্ভর করতে হতো। চমেক হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংককে ঘিরে খোলা মাঠে বসে থাকতো কিছু মাদকাসক্ত। ওরা মূলত নেশার টাকা জোগাড় করতেই নিজের রক্ত বিক্রি করতো। তিন মাসে একবার রক্ত দেয়ার নিয়ম থাকলেও মাসে এমনকি সপ্তাহে কয়েকবার রক্ত দিতো তারা। এসব পেশাদার বিক্রেতাদের রক্ত নিয়ে নানা জটিলতায় পড়েছে অনেক সঙ্কটাপন্ন রোগী। সে চিত্র এখন পাল্টে গেছে। পেশাদার রক্তদাতা এখন আর নেই বললেই চলে।
রক্ত দেয়ার পর তা রোগীর শরীরে দেয়ার আগে স্ক্যানিং করা হচ্ছে। স্ক্যানিংয়ে রক্তে কোন জটিল রোগের জীবাণু ধরা পড়লে সে রক্ত রোগীকে দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে রক্তদাতাকেও রোগ সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে রক্তদাতারা একদিকে যেমন সঙ্কটাপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচাতে সহযোগিতা করছেন। অন্যদিকে নিজের রক্তে কোন ভয়ঙ্কর রোগের জীবাণু বাসা বেঁধেছে কিনা তাও নিশ্চিত হতে পারছেন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। এ রক্তের প্রায় পুরোটাই আসছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মাধ্যমে। আশার কথা হলো রক্তদাতাদের প্রায় ৮০ ভাগই যুবক। চমেক হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চলন বিভাগ, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক এবং লায়ন্স ব্লাড ব্যাংকসহ মোট ছয়টি বৈধ ব্লাড ব্যাংক চট্টগ্রামে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের সমন্বয় করে থাকে বলেও জানান তিনি। অনুমোদনহীন আরও কিছু ব্লাড ব্যাংকও রয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন।
চমেক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, সেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৬০ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। চমেক হাসপাতালে রোগীদের ক্ষেত্রে প্রতিব্যাগ রক্তে স্ক্যানিং ফি বাবদ নেয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা। আর অন্য হাসপাতালে রোগীদের জন্য এ ফি ৫শ’ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। চমেক হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকটি খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা। সঙ্কটাপন্ন রোগীর চাপ বেশি থাকায় প্রায়ই ব্লাড ব্যাংকের সামনে রক্তদাতাদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। সন্ধানীর চমেক শাখার কর্মকর্তা, জারিন শরিফ সুপ্তি বলেন, আমরা দিনে ২০-৩০ ব্যাগ সরবরাহ করতে পারি। বছরে সাত থেকে আট হাজার ব্যাগ রক্ত সরবরাহ দেয়া হয়। অপর কর্মকর্তা শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন সন্ধানী বিনামুল্যে রক্ত সরবরাহ করে। এ কে খান ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি সমাজসেবামূলক সংস্থার সাহায্যে তারা রক্তের ব্যাগ সংগ্রহ ও স্ক্যানিং করে থাকে।
আন্দরকিল্লা ফাতেমা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি ডা. শেখ শফিউল আজম ইনকিলাবকে বলেন, এ ব্লাড ব্যাংকে দিনে ২শ’ ব্যাগের বেশি রক্ত লেনদেন হয়। স্ক্যানিং বাবদ ফি নেয়া হয় প্রতি ব্যাগ ৮শ’ টাকা করে। পেশাদার রক্ত বিক্রেতার অস্তিত্ব এখন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে সংগৃহীত রক্ত এ ব্লাড ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়। এর পাশাপাশি অনেকেই নিয়মিত রক্ত দেন।
তিনি জানান, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চলন আইন-২০০২ এর আলোকে কোনো মাদকাসক্ত ও পেশাদার ব্যক্তির দেয়া রক্ত গ্রহণ না করতো কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্ধানীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রক্ত দেয়ায় সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করে যাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করার পাশাপাশি এসব সংগঠনের উদ্যোগে রক্তদান কর্মসূচিও আয়োজন করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি রক্ত সংগ্রহ করা হয় জাতীয় দিবস এবং বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে। তবে চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক থাকলেও চাহিদার তুলনায় রক্ত সরবরাহ এখনও অপ্রতুল। এখনও রক্তের অভাবে অনেক রোগী মারা যাচ্ছেন।
চিকিৎসকরা জানান, সবচেয়ে বেশি রক্তের প্রয়োজন হয় সন্তান প্রসবকালীন সিজার ও জরুরি অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে। এছাড়া রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া ও বাইপাস সার্জারি রোগী, ওপেন হার্ট সার্জারি, কিডনি ডায়ালাইসিস, ব্লাড ক্যান্সার, লিভার ও দুর্ঘটনায় আহত, রক্ত বমি রোগ এবং ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর ক্ষেত্রেও জরুরি রক্তের প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ১৮-৬০ বছর বয়সী সুস্থ-সবল মানুষ প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ত দিতে পারেন। রক্ত দিলে দেহে নতুন ব্লাড সেল তৈরি হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, অস্থিমজ্জা, নতুন কণিকা তৈরিতে উদ্দীপ্ত হয়।
তরুণদের বিরাট একটি অংশ নীরবেই রক্তদানের মতো মানবিক দায়িত্ব পালন ইতিবাচক মন্তব্য করে সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, অন্যের জীবন বাঁচাতে রক্ত দেওয়ার ফলে তরুণদের মধ্যে ত্যাগের মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এটি তাদের বাস্তবজীবনেও প্রভাব ফেলবে। তাদের মধ্যে আরও অনেক মানবিকগুণের বিকাশ ঘটবে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আর মাদকাসক্তি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়ে তরুণদের স্বেচ্ছায় রক্তদান সত্যিই প্রসংশার দাবিদার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ