Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঋণ নিয়ে জীবন চালান ৮৭% পোশাক শ্রমিক

অক্সফাম অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেদন

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:৩৮ এএম

ঢাকার আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন নাসিমা আক্তার। ছয় বছর আগে হেলপার হিসেবে এ পেশায় আসা নাছিমা দুই বছর ধরে অপারেটরের কাজ করছেন। পোশাক খাতে কর্মজীবনের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও দারিদ্র্য ও অভাব এখনো পিছু ছাড়েনি তার। পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে সঞ্চয় তো দূরে থাক, জীবনযাপনের জন্য উল্টো ঋণ নিতে হয়েছে এ শ্রমিককে। আবার দৈনন্দিন কেনাকাটাও চলে তার বাকিতে।
শুধু নাসিমা নন, অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন শিল্প পোশাক খাতের সিংহভাগ শ্রমিকের। অপ্রতুল মজুরির কারণে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে অনেক সময়ই তিন বেলা খাবার জোগানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে তাদের। এজন্য বাধ্য হয়ে ঋণ নিতে হয় এসব শ্রমিককে। আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ৮৭ শতাংশকেই জীবনযাপনের জন্য ঋণ নিতে হয়।
মাঠপর্যায়ে শ্রমিকদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে চলতি মাসেই ‘মেড ইন প্রভার্টি, দ্য ট্রু প্রাইস অব ফ্যাশন: হোয়াট শি মেকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে অক্সফাম অস্ট্রেলিয়া। জরিপের জন্য বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের পোশাক কারখানার ৪৭০ জনেরও বেশি শ্রমিকের সাক্ষাতকার নেয়া হয়। অস্ট্রেলীয় ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলোর কাছে পোশাক সরবরাহ করে এসব কারখানা। কোয়ান্টিটেটিভ ও কোয়ালিটেটিভ পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ায় পোশাকের বাজার ২৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবনযাপনের জন্য ন্যুনতম প্রয়োজনীয় মজুরি পান না বাংলাদেশের শতভাগ পোশাক শ্রমিক। তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ফারাক অনেক। ফলে ৮৭ শতাংশ শ্রমিক জীবন চালান ঋণ নিয়ে। তাদের দৈনন্দিন কেনাকাটাও হয় বাকিতে। ৫৬ শতাংশ পোশাক শ্রমিক স্থানীয় দোকান থেকে বাকিতে পণ্য কিনে থাকেন।
প্রতিবেদনের জন্য পরিচালিত সমীক্ষায় সহযোগী বাংলাদেশী সংস্থা ছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস)। বাংলাদেশের ১৬০টিরও বেশি কারখানার শ্রমিক সমীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।প্রতিবেদনের প্রারম্ভিক মন্তব্যে অক্সফাম অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী ড. হেলেন এসজোক বলেন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের শত শত শ্রমিকের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে করা ওই গবেষণায় পোশাক খাতে খুবই স্বল্প মজুরি ও শ্রমিক পরিবারগুলোর দারিদ্র্যের চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে শ্রমিকের মজুরি ও ঋণমাত্রা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১০০ শতাংশ পোশাক শ্রমিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি হারের চেয়ে কম আয় করেন। প্রতি ১০ জন শ্রমিকের নয় জনের উপলব্ধি হলো, তাদের আয় পর্যাপ্ত নয় অথবা চাহিদা মেটানোর জন্য আংশিক।
অভাবে পড়ে শ্রমিকের ঋণগ্রস্ত হওয়ার তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেয়া ৮৫ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তারা নিয়মিতই টাকার অভাবে পড়েন। জীবন ব্যয় নির্বাহের জন্য ঋণ নিতে হয় বলে জানিয়েছেন ৮৭ শতাংশ শ্রমিক। তারা এ ঋণ নেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের কাছ থেকে। ঋণের এ অর্থ দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে ব্যয় করেন তারা।
বাংলাদেশী পোশাক শ্রমিকের খাদ্য ও পুষ্টি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯১ শতাংশ শ্রমিক তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার সামর্থ্য রাখেন না। যার অর্থ দাঁড়ায়, শ্রমিকরা দৈনন্দিন খাদ্যের উপকরণ হিসেবে ডাল, চাল ও আলুর ওপর বেশি নির্ভরশীল। মাত্র ১০ শতাংশ শ্রমিক প্রতিদিন নিয়মিত খাবার গ্রহণ করেন। ৩৩ শতাংশ শ্রমিককে নিয়মিতভাবে তাদের দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয় অথবা অপ্রতুল খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।
প্রতিবেদনে অতিরিক্ত কাজের প্রভাব প্রসঙ্গে বলা হয়, ৯৯ শতাংশ শ্রমিক অতিরিক্ত সময় কাজ করেন। ৩ ঘণ্টার বেশি অতিরিক্ত সময় কাজ করেন ৫৫ শতাংশ শ্রমিক। অতিরিক্ত সময় কাজ করা বা রাতের কাজের দায়িত্বকে ‘না’ বলতে পারেন না ৮৪ শতাংশ শ্রমিক।
শ্রমিকের স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭২ শতাংশ শ্রমিক অসুস্থ হলে যথাযথ চিকিৎসার সামর্থ্য রাখেন না। যদিও এজন্য ছুটি নেন না বেশির ভাগ শ্রমিক। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ শ্রমিক অসুস্থতাজনিত ছুটি ভোগ করেন না। ৬৬ শতাংশ জানিয়েছেন, গর্ভবতী নারীকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। মাতৃত্বজনিত ছুটি নিতে হলে অতিরিক্ত সময় কাজের চাপও বহন করতে হয়।
শ্রমিকের আবাসন ও জীবন পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ শ্রমিককেই থাকতে হয় ঘিঞ্জি আবাসনে। এক ঘরে গড়ে তিনজন করে বসবাস করেন শ্রমিকরা। ঘরের গড় আয়তন ১৮৯ দশমিক ৮ বর্গমিটার। ৯৬ শতাংশ শ্রমিক ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন, যাদের সবাই বাড়ি ভাড়া বেড়েছে বলে জানিয়েছেন। এর বিপরীতে মাত্র ৬৪ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের মজুরি বেড়েছে। ৫৮ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, বর্ষা মৌসুমে তাদের ঘরে পানি প্রবেশ করে। ৭৬ শতাংশ শ্রমিকের আবাসস্থলে নিয়মিত পানির ব্যবস্থা নেই। গড়ে ১৬ জন শ্রমিককে একটি পানির উৎস ব্যবহার করতে হয়।
পোশাক শ্রমিকদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে বলে মনে করেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে মানসম্পন্ন আবাসন, পুষ্টি ও আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনায় নেয়া হয় না। সেজন্যই পোশাক শ্রমিকের মজুরির হার লিভিং ওয়েজের চেয়ে অনেক নিচে। একটি পোশাক উৎপাদন থেকে আয়ের অধিকাংশই পান ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা। সেখানে শ্রমিকরা পান খুব সামান্যই। শ্রমিকদের ঋণগ্রস্ততা তাই খুবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে অংশ নেয়া ৮৫ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, পরিবার শিক্ষার ব্যয় বহনে অসমর্থ হওয়ায় অল্প বয়সেই স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাদের। বর্তমানে তারা যে মজুরি পান, তা সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন ৮৯ শতাংশ শ্রমিক।
প্রতিবেদনে শ্রমিকদের প্রতি দুর্ব্যবহার, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২৮ শতাংশ শ্রমিক যৌন নির্যাতন ও ৩৫ শতাংশ শ্রমিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া ৮৮ শতাংশ শ্রমিক মৌখিক দুর্ব্যবহারের শিকার হওয়ার তথ্য দিয়েছেন সাক্ষাতকারে।
শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা বিষয়ে অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জনে আটজনের বেশি পোশাক শ্রমিক চাকরি হারানোর ভয়ে থাকেন। যদিও ভিয়েতনামে এ ভয়ে থাকেন প্রতি চারজনের একজন শ্রমিক।



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Alam Khan ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৮:০২ এএম says : 0
    বাংলাদেশে শ্রমিকদের কল্যাণের জন্যেই শ্রমিক সংগঠনের অনুমতি সরকার দিয়ে থাকে কিন্তু শ্রমিক নেতারা কি শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করছে নাকি শ্রমিকদের কাছ থেকে উল্টা টাকা নিয়ে মানে চাদা নিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে এসব দেখার দায়িত্ব কার??? নিশ্চয় সরকারের কিন্তু সরকার কি এসব দেখছেন??? আমি জানি সরকার শ্রমিক নেতাদের সাথে আঁতাত করে নিজেদের পকেট ভাড়ি করছে সাথে সাথে মালিকেরাও শ্রমিক নেতাদের জন্য নিয়মিত মাশোয়ারা দিয়ে আসছে। এটাকে বলা হয় ‘ওপেন সিক্রেট’ সবাই জানে আবার কেহই জানে না। আমাদের দেশের শ্রমিকরা হচ্ছে অভাগা এদেরকে সহযোগিতা করার জন্যে বিদেশী ক্রেতারা কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন বাধ্যতা মূলক ভাবে করার কথা বলায় আমি দেখেছি ৯০% ইউনিয়ন মালিকেরা নিজেই তাদের কিছু শ্রমিকদের দিয়ে করিয়ে শ্রম দপ্তরে জমা দিয়ে তালিকা ভুক্ত করিয়ে নিচ্ছে (বানিজ্যের মাধ্যমে) বিদেশীদের দেখানোর জন্য। আবার কয়েকটা কারখানার মালিক আবার একটা ফেডারেশনও দাড়করিয়ে ফেলছে তাদের নিজেদের শ্রমিক দিয়ে। ফলে সবাই তাদের পকেট বানিজ্যে লিপ্ত তাই শ্রমিকেরা যেমন আছেন তাঁর চেয়েও খারাপ হচ্ছেন। আমার অভিজ্ঞতা মতে এখন যদি প্রধানমন্ত্রী নিজে এই শ্রম দপ্তরকে নিয়ন্ত্রণে নেন তাহলে আমি বলতে পারি যে কয়টা ফেডারেশন আছে তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হবে। আমি আরো দেখেছি কারখানার পুলিশ এনারাও মালিক শ্রমিক এবং মন্ত্রী এদের সবার সাথেই সম্পর্ক রেখে সেইভাবেই কাজ করেন, সেখানেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রন নেই। যেভাবে শ্রমিকদের সংগঠন চলছে এভাবে চলতে থাকলে শ্রমিকরা দিন দিন সর্বস্বান্ত হয়ে একসময় পৃথিবী ছেড়ে দেনা ঘাড়ে নিয়েই চলে যাবে এটাই সত্য।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ