Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঝুঁকির মধ্যেই জনগণের জীবন রক্ষায় ফায়ার ব্রিগেড

দেশের ৪০২ স্টেশনে প্রায় ১০ হাজার কর্মী

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

দুর্ঘটনার সাথে সাথেই উদ্ধার অভিযান : জনগণের জান-মালের গুরুত্ব সর্বাগ্রে


প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যে কোন দুর্যোগে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। বাহিনীটি নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। দেশের কোথাও কোন দুর্ঘটনা বা বিপদের খবর পাওয়া মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। সংস্থাটির যাত্রার পর থেকে গতি, সেবা ও ত্যাগের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মানব সেবায় নিয়োজিত রয়েছে একদল প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মী বাহিনী। গত বৃহস্পতিবারও রাজধানীর চকবাজারের চুরিহাট্টায় অগ্নিকাÐের পর নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ফায়ার ব্রিগেডের দু’শোর বেশি কর্মী। এছাড়া সারাদেশে ৪০২টি ফায়ার স্টেশনের প্রায় ১০ হাজার কর্মী বাহিনী দিয়ে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় বাহিনীটি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।
দেশের সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম সাড়া প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে অগ্নি নির্বাপণ, অগ্নি প্রতিরোধ, উদ্ধার, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা, মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে প্রেরণ ও দেশী-বিদেশী ভিআইপিদের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একইভাবে প্রাকৃতিক ও কৃত্তিম যেকোন দুর্যোগে সবার আগে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে যাত্রা শরু করে বাহিনীটি। এরপর থেকে সব সময় সংস্থাটির কর্মীরা জবীন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আরও অনেকে। তারপরেও দায়িত্ব পালনে সংস্থাটির কর্মী বাহিনীর আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। ফায়ার ফাইটাররা নিজের জীবন বাজি রেখে প্রতিনিয়ত অন্যের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে চলেছেন। যদিও সময়ের সাথে সাথে তাদের সক্ষমতা, কাজের পরিধি ও তৎপরতা অনেকগুণ বেড়েছে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নি নির্বাপনসহ উদ্ধার কাজ, জলমগ্ন রাস্তায় মানুষকে পারাপার, অধিক বৃষ্টিতে মানুষ ও পশু পাখিদের উদ্ধার ও নিরাপদ আশ্রয়, রানা প্লাজাসহ বড় বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার ও নিরাপদ আশ্রয় প্রদানে বাহিনীর কর্মীরা নজীরবিহীন ভূমিকা রেখেছে।
তেমনিভাবে গত বৃহস্পতিবারে চকবাজারের চুরিহাট্টার আগুনের খবর শোনার সাথে সাথেই নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী বাহিনী। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ঢাকার ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিটের দু’শোর বেশি কর্মী ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভাতে কাজ করেন। তারা প্রায় ১০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন পুরোপুরি নির্বাপন করতে সক্ষম হন।
অগ্নিকাÐের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, আগুন নেভানোর কাজ করার সময় ভিজে জবুথবু হয়ে একাকার হলেও কাজ চলতে থাকে। অনেক সময় আগুন নেভাতে নেভাতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের খুব কাছাকাছি চলে গেছেন। অনেকে কাজের ভেতরে এতটা মগ্ন থাকেন যে ঝুকিপূর্ণ ভবনের ভেতরে ঢুকে পরলেও বুঝতে পারেন না।
অগ্নি নির্বাপন কাজে অংশগ্রহনকারী সংশ্লিষ্ট কর্মীরা বলেন, পুরান ঢাকার ভেতরে আগুন নেভানোর কাজ অনেক কঠিন। একদিকে সরু রাস্তাঘাট, এর বাইরে ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক বড় গাড়িগুলো ভেতরে ঢুকানো যায় না। কয়েকজন কর্মী বলেন, কেমিক্যালের আগুন অন্য যেকোন আগুনের চেয়ে অনেক মারাত্মক। সাধারণ আগুন সহজে নেভানো গেলেও কেমিক্যালের আগুন নেভাতে অনেক বেগ পেতে হয়। কোথাও ধোয়া থাকলে সেখান থেকে আবারও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। এ ছাড়া পুরানো ঢাকায় সর্বদা পানির সঙ্কট থাকে চরমে। কয়েকজন কর্মী বলেন, কেমিক্যালের ধোয়ার মধ্যে নির্বাপন ও উদ্ধার কাজ অনেক কষ্টসাধ্য। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তবুও মাথার ভেতরে সেসব কাজ করে না। একমাত্র মানুষের জান-মাল রক্ষার বিষয়টি ভাবনায় থাকে। যার কারণে অনেক সময় ঝুঁকি নিয়েও ফায়ার ফাইটারদের কাজ করহে হয়। এভাবে কাজ করতে গিয়ে অতীতে অনেক কর্মীর প্রাণহানিও ঘটেছে।
গত বৃহস্পতিবার চকবাজারের চুরিহাট্টা গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ডাম্পিংয়ের কাজ করছেন। কোথাও কেমিক্যাল বা দাহ্য পদার্থ পড়ে আছে কিনা সেগুলো তল্লাশী করছেন। ধোয়া বের হতে পারে এমন সম্ভাব্য জায়গায় পানি ছেটাচ্ছেন। ভোরের দিকে অনেক কর্মী উদ্ধার হওয়া পোড়া লাশ ও আহত রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ঢাকা মেডিক্যাল মর্গের সামনেও সংস্থাটির কর্মীদের একইরকম তৎপরতা দেখা গেছে। কারো দম ফেলার ফুরসত নেই। প্রত্যেকেই কাজে ব্যস্ত। দেখা গেছে, কেউ মৃতদের তালিকা নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কেউ লাশের পরিচয় সনাক্তে কাজ করছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন সংস্থার সাথে মিলে সনাক্ত হওয়া লাশগুলো স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
চুরিহাট্টার নির্বাপন ও উদ্ধার কাজের বর্ণনা দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন বলেন, সাধারণত দু’ভাবে তথা আক্রমনাত্মক ও প্রতিরোধমূলকভাবে নির্বাপন কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে চকবাজারে গিয়ে প্রথমে অনেক মানুষের জটলার মুখোমুখি হই। এছাড়া পানির সঙ্কট ও প্রতি মুহুর্তে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। যাতে আতঙ্ক বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, কাজের স্ট্রাটেজি হিসেবে প্রথমে ডিফেন্সিভ পদ্ধতি নেওয়া হয়। নির্বাপনের সাথে সাথে আশপাশের ভবনে যেন আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য আগুনকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ রেখে পরবর্তী কাজ করা হয়। সালেহ উদ্দিন বলেন, কেমিক্যালের গোডাউনে অনেক ঝুঁকি থাকায়ও ফায়ার সার্ভিসকে অবস্থা বুঝে এগুতে হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের এত উদ্যোম ও তৎপরতার পরেও নানা সময়ে বিরূপ মন্তÍব্য ও অবহেলার অভিযোগ ওঠে বাহিনীটির বিরুদ্ধে। মানুষের মনোপুত না হলেই তারা ফায়ার সার্ভিসকে গালি-গালাজ করে। অথচ অনেক সময় নাগরিকদের উদাসীনতা ও নিয়ম অমান্যের কারণে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। যে বিষয়গুলো তারা কখনো চিন্তা করে না। জনগণের ভাবখানা এমন যেÑ আগুন লাগার পেছনে একমাত্র দায়ই ফায়ার সার্ভিসের!
ফায়র সার্ভিসের কর্মীরা জানান, সকাল কিংবা রাত নয়, আগুনের খবর পাওয়া মাত্রই তাদেরকে বেড়িয়ে পড়তে হয়। এভাবে এক কাজের পর আবার শুরু হয় অন্য কাজ। আগুন নিভলেও তাদের জীবনের ফুরসত মেলে না। মাথার ভেতরে সর্বদা দুর্ঘটনার সাথে সাথে বেড়িয়ে পড়তে হবে এমন মানসিকতা কাজ করে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বর্তমানে ৪০২টি ফায়ার স্টেশন ও ১০ হাজারের কাছাকাছি কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে সংস্থাটির সক্ষমতা ও লোকবল বাড়াতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এতে ভবিষ্যতে ৫৬৫টি ফায়ার স্টেশন ও জনবল বেড়ে ২৫ হাজারের বেশি হবে।
সামগ্রিক বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ফায়ার সার্ভিস একটি জীবন রক্ষাকারী বাহিনী। এজন্য ঝুঁকির মধ্যেই সর্বদা বাহিনীর সদস্যদের কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, কোন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই মূহুর্তেই ফায়ার ফাইটাররা বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু অবকাঠামোগত নানা সমস্যরা কারণে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। তিনি বলেন, আধুনিক প্রসস্থ রাস্তা নির্মাণ, পানির উৎসের সহজ লভ্যতা ও জনগণের ক্রাউড কমানোর পাশপাাশি জনগণকে সচেতন করা গেলে অনেক সহজে কাজ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আগামীতে আরও স্টেশন ও জনবল বাড়বে। তখন খুব সহজে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ