Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের মর্যাদার লড়াই

শামসুল হুদা লিটন, কাপাসিয়া (গাজীপুর) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-৪, কাপাসিয়া আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী ৭ জন প্রার্থী থাকলেও কাপাসিয়ার আলোচিত দুই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য বড় দুই দলের প্রার্থীর নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের মাঝেই মূল প্রতিদ্ব›িদ্বতা হবে। একজন হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের মেঝ মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি। অপরজন হলেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী, দলের স্থায়ী কমটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী মরহুম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ’র পুত্র শাহ্ রিয়াজুল হান্নান। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের প্রার্থীর ভরসাই হলো তাদের মরহুম পিতার ইমেজ। নির্বাচনী মাঠের প্রচার-প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমি। কিন্তু হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে কৌশলে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নান। সেনাবাহিনী নামার পর শাহ্ রিয়াজুল হান্নান অনেকটা প্রকাশ্যে ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন।
নির্বাচনের বাকী আর মাত্র কয়েকদিন। ইতিমধ্যে সাধারণ ভোটাররা তাদের ভোটের হিসাব কষতে শুরু করেছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম, হুলিয়া ও থানা পুলিশের অব্যাহত চাপের মুখে তারা বাড়িছাড়া। ইতিমধ্যে বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় ৫শ’ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা হয়েছে। এতকিছুর পরও বিএনপি প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নান মাঠ ছাড়ছেন না।
গাজীপুর-৪ কাপাসিয়া, নির্বাচনী আসনটি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯৪ জন। এটি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযোদ্ধের অগ্রনায়ক বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী এলাকা। এই আসনে তাজউদ্দীন আহমদের মেঝ কন্যা সিমিন হোসেন রিমি বর্তমান এমপি। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহ্। তার পুত্র শাহ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ আগামী সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন। হান্নান শাহ্’র মৃত্যুর পর উপজেলা বিএনপির সব পর্যায়ের নেতা শাহ্ রিয়াজুল হান্নানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। বঙ্গতাজের একমাত্র পুত্র তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও পরে পদত্যাগ করেন।
সারা দেশের মতো গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনেও নির্বাচনের পালে হাওয়া লেগেছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারিত থাকায় সময় গুণে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের দুইবারের এমপি প্রবীণ প্রার্থী বঙ্গতাজ সিমিন হোসেন রিমি আর বিএনপির নবীন প্রার্থী হান্নান শাহ্ পুত্র শাহ্ রিয়াজুল হান্নান। উভয়েই পরিবারের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ের পথে হাঁটছেন বলে তাদের প্রত্যাশা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে চলছে শোডাউন ও প্রচার। বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি নিয়মিত সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। তার সমর্থকরা ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘আমার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ দেশ-জাতির জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস বিগত দিনের মত কাপাসিয়াবাসী আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। জনগণ আবার আমাকে নির্বাচিত করলে মাদকমুক্ত সমাজ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখব’। কাপাসিয়াকে সবুজ অর্থনীতি গড়তে চান সিমিন হোসেন রিমি। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আরো মনোযোগ দিতে চান। গ্রামকে শহরে পরিণত করব।
অপরদিকে প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করছে। স্থানীয় নবীন ও প্রবীণ নেতাকমীরা হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে প্রতিকুল পরিবেশেও দলীয় কর্মকান্ডে একাট্টা। হান্নান শাহ্র মৃত্যুর পর তার পুত্র শাহ্ রিয়াজুল হান্নান হাল ধরেছেন। নেতাকর্মীরা মনে করেন, রিয়াজ তার পিতা হান্নান শাহ্র প্রতিচ্ছবি। প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও ২০০৮ সালের পর থেকে কাপাসিয়ার সব ইউনিয়নের তৃণমূল নেতারা দলীয় কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ডা. ছানাউল্লাহ্, ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। এ নির্বাচনে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা মো. ওবায়দুল্লাহ্ নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহ্ আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মিনী জোহরা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ছোট ভাই অ্যাডভোকেট আফছার উদ্দিন আহমদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহ’র সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে জয়লাভ করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র তানজিম আহমদ সোহেল তাজ হান্নান শাহ্র সঙ্গে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। তারপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিএনপি থেকে অর্থনীতিবিদ এম, এ আব্দুল মজিদ প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে প্রায় ৬৭ হাজার ভোট পেলেও সোহেল তাজ বিজয়ী হন। তারপর সোহেল তাজ প্রথমে মন্ত্রীত্ব থেকে, পরে সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করলে এ আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামীগ থেকে তার বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি তার আপন চাচা অ্যাডভোকেট আফছার উদ্দিন আহমদের (স্বতন্ত্র প্রার্থী) সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী দশম সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া স্বতন্ত্রপ্রার্থী ড. মিয়া মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে সিমিন হোসেন রিমি আবারও নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী ৬ বার নির্বাচিত হয়। বিএনপি ৩ বার এবং একবার স্বতন্ত্রপ্রার্থী নির্বাচিত হন। কাপাসিয়ায় বরাবরই তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থীর মাঝে ভোটের ব্যবধানও খুব একটা বেশি নয়। তবে বিভিন্ন কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারের মতামত অন্যরকম। ভোটের মাঠে সচেতন ভোটাররা মুখ খুলতে নারাজ। বাহ্যত ভোটাররাও যেন কৌশলী। এসব নীরব ভোটাররাই জয়-পরাজয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। আগামী ৩০ ডিসেম্বর সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিজয়ের শেষ হাসি কে হাসবে তার জন্য নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মানবেন্দ্র দেব (কাস্তে), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. নাজিম উদ্দিন শেখ (তারা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত আলহাজ¦ মো. নূরুল ইসলাম সরকার (হাতপাখা), জাকের পার্টি মনোনীত প্রার্থী ডা. মো. জুয়েল কবির (গোলাপ ফুল), বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রার্থী মোহাম্মদ সারোয়ার-ই-কায়নাত (টেলিভিশন)। ইতোমধ্যে সকল প্রার্থীই এলাকায় সাধ্যমতো তাদের গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাপাসিয়ায় ১১৯টি ভোট কেন্দ্রে ৫২৬টি বুথে ভোট গ্রহণ করা হবে। ১ হাজার ৫২ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। এ আসনে এবারের মোট ভোটার ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯৪ জন। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৮৫ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫০৯ জন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ